কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২৪

জাহাজভাঙা শিল্পে গতি ফিরছে না

গতি ফিরে পাচ্ছে না বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্প। করোনাকালীন ভালো ব্যবসা করে এগিয়ে থাকলেও এখন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে শিল্পটি। জাহাজভাঙা শিল্প থেকে বাংলাদেশ বিপুল রাজস্ব আয় করে।

অভিযোগ রয়েছে, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী এ শিল্পকে কেন্দ্র করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লুটপাটে ব্যস্ত ছিল। এছাড়া বেশি লাভের আশায় টক্সিক জাহাজের প্রতি আগ্রহ, অতিরিক্ত লোভ, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি না দেওয়া, শ্রমিকদের জীবন নিয়ে অবহেলাসহ নানা কারণে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একে একে বন্ধ হয়ে গেছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। লোনের টাকা না পেয়ে অনেক ব্যাংক ঘুরছে ব্যবসায়ীদের দ্বারে দ্বারে। অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে যে, হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বাকি সব ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ একসময় ১৬০টি ইয়ার্ড জাহাজভাঙার কাজে সক্রিয় ছিল।

সংশ্লি­ষ্ট সূত্রে জানা যায়, ৬০-এর দশকে সীতাকুণ্ড সাগর উপকূলে জাহাজভাঙা শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। এরপর এ শিল্প আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। একসময় বলা হতো জাহাজভাঙা শিল্প মানেই ব্যাপক লাভ। ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো বিস্তৃতি ঘটে ইয়ার্ডের। ব্যাংকগুলো ঋণ নিয়ে বসে থাকে। বিশেষ করে ৮০-এর দশক তো এ শিল্পের জন্য স্বর্ণযুগ বলা চলে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে এ সময় থেকে সীতাকুণ্ডের শিপব্রেকিং ইয়ার্ড শিরোনাম হতে থাকে। সস্তা শ্রম, পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়ার কারণে ধীরে ধীরে জাহাজভাঙা শিল্পে বিনিয়োগ করে দেশের প্রায় বড় বড় শিল্প উদ্যোক্তা। স্ক্র্যাপ জাহাজভাঙা লোহার ওপর নির্ভর করে এখানে গড়ে ওঠে অসংখ্য রি-রোলিং মিলসসহ নানা কল-কারখানাও। ফলে এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠে ব্যাংকগুলোও। বলাবাহুল্য শুধু শিপইয়ার্ড মালিকদের হাতের নাগালে সেবা পৌঁছে দিতে এ উপজেলায় শাখা খুলতে থাকে তারা। এভাবে ব্যাপক সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠা শিল্পটি প্রতি বছর ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টনেরও বেশি লোহা উৎপাদনের মাধ্যমে দেশে নির্মাণশিল্পে গতি ফিরিয়ে আনে। যা অব্যাহত ছিল কয়েক বছর।

দিন যত যায় একের পর এক ইয়ার্ডে দুর্ঘটনা। বছরে শত শ্রমিকের মৃত্যু। শ্রমিকদের নিরাপত্তার অভাবের বিষয়টিও যখন আন্তর্জাতিক মাধ্যমে শিরোনাম হতে থাকে তখন এ শিল্পের গতি থামতে থাকে। এমন একটা ইয়ার্ডে আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থাগুলো জাহাজ পাঠাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ধীরে ধীরে কেটে যায় এ শিল্পের মোহ।

করোনাকালে অনেকটা হঠাৎ করে বাংলাদেশে জাহাজভাঙার অবস্থান এক নম্বরে চলে আসে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশের এ অবস্থান যে সাময়িক তা বুঝতে দেরি হয়নি। করোনা যাওয়ার পরপর বাংলাদেশ আবার সেই তিমিরেই চলে আসে। গত ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ২৩৬টি, ২০২০ সালে করোনার চরম সময়ে ১৪৪টি, ২০২১ সালে আবার ২৫৪টি জাহাজ বাংলাদেশে ভাঙার জন্য আমদানি হয়। কিন্তু ২০২২ সালে এটি নেমে আসে ১২২-এ। ২০২৩ সালের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০০ অতিক্রম করেনি।

চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা শিল্পকে কোন শ্রেণিতে ফেলা হবে এ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। আন্তর্জাতিক মহলের একটি গ্রুপ চাইছে বাংলাদেশের বেশির ভাগ ইয়ার্ড ‘লাল’ শ্রেণির। লাল শেণি হচ্ছে পরিবেশের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ। সারা বিশ্বের যেসব দেশে জাহাজভাঙা হয় তাতে ‘কমলা’ অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ কমলা শ্রেণি হলে আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো জাহাজ পাঠাতে বাধা দেয় না। সাধারণত কমলা শ্রেণিকে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের যেসব ইয়ার্ড লাল শ্রেণিতে রয়েছে সেগুলো কিছু নিয়মণ্ডকানুন মেনে কমলা শ্রেণিতে ফেরার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। গত প্রায় ২৭ বছর ধরে চলছে ‘লাল’ ও ‘কমলা’ রঙের লড়াই।

সম্প্রতি জারি করা পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩-এ শিল্পটিকে লাল শ্রেণিভুক্ত করার পর ব্যবসায়ীরা তা প্রত্যাহারে তৎপর হন। এরই অংশ হিসেবে জাহাজভাঙা শিল্পকে ‘কমলা-খ’ শ্রেণিতে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়া অধিশাখা থেকে। গত ২০২৩ সালের ১৫ মে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মোমিনুর রশীদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, জাহাজভাঙা শিল্পকে প্রথম ১৯৯৭ সালে কমলা-খ শ্রেণিভুক্ত করা হয়। ২০০৭ সালে আনা হয় ‘লাল’ শ্রেণিতে। দেশে-বিদেশে এ নিয়ে প্রভাব পড়লে ২০২০ সালে আবার এই শিল্পকে আনা হয় কমলা-খ শ্রেণিতে।

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সভাপতি আবু তাহের বলেন, ‘এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। লাল আর কমলা শ্রেণির জন্য লড়াই করতে করতে আমরা ক্লান্ত।’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে সূত্র জানায়, জাহাজ নির্মাণ ও মালিকানায় বিশ্বসেরার তালিকায় বাংলাদেশ নেই। তবে জাহাজভাঙায় বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে বিশ্বে যত জাহাজভাঙা হয়েছে, তার ৪৭ দশমিক ২ শতাংশই বাংলাদেশে ভাঙা হয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন ও বাণিজ্য সংস্থা ‘আঙ্কটাড’ প্রকাশিত ‘রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০১৯’ শীর্ষক প্রকাশনায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এ বছরের ৩০ অক্টোবর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন, জাহাজ নির্মাণ, মালিকানা ও নিবন্ধন এবং সমুদ্র যোগাযোগে দেশগুলোর অবস্থান নিয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, জাহাজভাঙায় বাংলাদেশের পরের অবস্থান ভারতের। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ৮৬ লাখ টন আয়তনের জাহাজ ভেঙেছে। ভারতে ভাঙা হয়েছে ৪৬ লাখ ৯০ হাজার টন আয়তনের জাহাজ। এরপরের অবস্থান যথাক্রমে পাকিস্তান, তুরস্ক ও চীনের। ২০১৭ সালে জাহাজভাঙায় শীর্ষস্থানে ছিল ভারত।

করোনাকালে বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেললেও এখন আবারও ভারত শীর্ষে। জাহাজভাঙা শিল্পে আশির দশকে নেতৃত্বে ছিল তাইওয়ান। নব্বইয়ের দশকে তাইওয়ানের সঙ্গে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া এই খাতে নেতৃত্ব দেয়। এরপরের দুই দশকে ভারত ও চীন ছিল জাহাজভাঙায় শীর্ষে। গত এক দশক ধরে এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও মাঝে মাঝে শীর্ষ স্থানে ওঠে আসে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে ২০২০ সালে করোনার পর জাহাজভাঙার জন্য বাংলাদেশই আসলে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য। গত তিন বছরে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক ৫২০টিরও বেশি জাহাজভাঙার কাজে জড়িত ছিলেন, যা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি।

গণমাধ্যম সূত্র জানায়, তাদের এই প্রতিবেদন তৈরিতে ৪৫ জন জাহাজভাঙা শ্রমিক, শ্রমিকের আত্মীয়-স্বজন, ১০ জন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে (আইএলও) উদ্ধৃত করে সংস্থাটি বলেছে, জাহাজভাঙা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজ। শ্রমিকরা ধারাবাহিকভাবে বলেছে যে, তাদের নিরাপদে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণের দরকার তা কখনোই দেওয়া হয় না। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশের অন্য মানুষের চেয়ে এই শিল্পে কাজ করা মানুষের গড় আয়ু ২০ বছর কম বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close