শাহ আলম, খুলনা

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪

বিল ডাকাতিয়ায় কৃষকের দুর্ভোগ

* এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই * স্থায়ী জলাবদ্ধতায় চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত * কষ্টের সীমা নেই কৃষিজীবীদের

একসময় এ অঞ্চলের কৃষিজীবীদের জন্য আশীর্বাদ ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ডাকাতিয়া বিল। উৎপাদন হতো প্রচুর পরিমাণ ধান, সবজি এবং মাছ। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে এ অঞ্চলে তখন বিরাজ করত একটি বর্ণাঢ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহ। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই বিল ডাকাতিয়া এখন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর একমাত্র কারণ জলাবদ্ধতা ও জল নিষ্কাশন সমস্যা।

খুলনার ফুলতলা, ডুমুরিয়া এবং যশোর জেলার অভয়নগর, কেশবপুর উপজেলা নিয়ে বিল ডাকাতিয়ার বিস্তৃতি। বিলটিতে চাষাবাদযোগ্য ৩০ হাজার একর জমি রয়েছে। একসময় বিল ডাকাতিয়ার ৫৫ শতাংশ পরিবার ছিল কৃষিজীবী। বিগত ১৫ বছর ধরে এ অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আর গত ৫ বছর ধরে এ সমস্যা আরো প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে এ অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ পরিণত হচ্ছে জেলেতে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ অন্যত্র চলে গেছে। বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা নিরসনে অনেক সভা, সেমিনার, আলোচনা সভা, মানববন্ধন হলেও এটির স্থায়ী সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয় বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিল ডাকাতিয়ার অনেক পকেট গেট রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর ইউনিয়নের মোজারগুটা, কৃষ্ণনগর, বটভিরা গ্রাম নিয়ে মোজারগুটা বিল। স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে এ তিনটি গ্রামের কয়েকশ কৃষিজীবী পরিবারকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। জমি থাকলেও তাতে ফসল উৎপাদন করতে না পারায় মাঝে মধ্যে তাদের অনাহারে থাকতে হয়। এছাড়া স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে দুর্ভোগের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। তখন বসতভিটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উপাসনালয় পানিতে তলিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে মোজারগুটা গ্রামের আড়াই থেকে ৩ হাজার মানুষের চলাচলের একমাত্র ইটের সড়কটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। তখন তাদের আর দুর্ভোগের সীমা থাকে না। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) খুলনা অঞ্চল থেকে গত ২২ জানুয়ারি মোজারগুটা বিলের জলবদ্ধতা নিরসনে ৫টি এলএলপি পাওয়ার পাম্প স্থাপন করলেও এর সুফল নিয়ে স্থানীয় কৃষিজীবীদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।

মোজারগুটা গ্রামের কৃষিজীবী প্রভাত মণ্ডল বলেন, এ এলাকা এবং আশপাশের এলাকার আমরা যত মানুষ আছি, সবাই আমরা এ জমিতে চাষাবাদ করে জীবন জীবিকা চালাই। কিন্তু স্থায়ী জলবদ্ধতার কারণে আমাদের সে জীবিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমার ৫-৭ বিঘা জমি থাকলেও না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। প্রত্যেক বছর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ বছর আমার তিনটি ঘেরের মাছ ভেসে যাওয়ায় প্রায় ৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের এ বিলে পাম্প বসাইছে কিন্তু আশপাশের বিলগুলোয় পানি থেকে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের সবাই আশ্বাস দিচ্ছে কিন্তু বাস্তবে কিছু হচ্ছে না। এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা বন্ধ করতে হলে শোলমারি স্লুইসগেট সংস্কার করতে হবে। ভবদহে যেমন মোটর (পাম্প) বসাইছে আমাদের এখানেও এরকম মোটর বসাতে হবে।’

একই গ্রামের কৃষিজীবী পল্টু মণ্ডল বলেন, ‘বিল ডাকাতিয়া তলায় যাচ্ছে। আমরা ধান চাষ, মাছ চাষ, সবজি চাষ কিছুই করতে পারছি না। বর্ষা মৌসুমে রাস্তায় জল উঠে যায়। এ জল নিষ্কাশনের জন্য শোলমারি স্লুইসগেটে মোটর বসাতে হবে, তাহলে আমাদের বিল ডাকাতিয়া উঠবে।’ মোজারগুটা গ্রামের অধিবাসী ও কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের শিক্ষক গণপতি মণ্ডল বলেন, নদী-নালা নেই। এখন পানি সরার আর কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে বহু লোকের বসবাস, বহু জমি জমা। এ এলাকায় যদি ফসল না হয়, তাহলে এলাকার মানুষ সব মারা যাবে। এ বছর আমার নিজের তিনটি মাছের ঘের পানিতে ভেসে গেছে। সব মিলিয়ে ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঋণী হয়েছি। এ মোজারগুটা বিলে ৪০০ থেকে ৫০০ একর জমি আছে। বিএডিসির লোকজন পাম্প বসানো বাবদ জমির মালিকদের কাছ থেকে বিঘাপ্রতি ২ হাজার টাকা করে নিয়ে এ বিলটা উঠানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, এলাকার উন্নয়ন হচ্ছে, সবকিছু ভালো হচ্ছে, কিন্তু আমরা খাব কী? এ নিয়ে গবেষণা চলছে। এ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ওপর মহলকে জানাই, কিন্তু জানাইয়ে কাজ না হলে আমরা কী করতে পারি?

স্থানীয় ইউপি সদস্য রমেশ চন্দ্র বৈরাগী বলেন, মোজারগুটা কৃষ্ণনগর বিলের মাঝখানে প্রায় ৪০০ বিঘার মতো জমি আছে। ১৫০টির মতো কৃষিজীবী পরিবার আছে। বর্তমানে নদীতে পলি পড়ে নাব্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে বিল ডাকাতিয়ায় ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, বিল ডাকাতিয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল। বিল ডাকাতিয়ার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ হচ্ছে শোলমারি স্লুইসগেট সংস্কার করা। ফলে নদীর নাব্য ফিরে পাবে। এ এলাকায় ফসল উৎপাদনের জন্য এমপি এবং বিএডিসির সহযোগিতায় মোজারগুটা কৃষ্ণনগর সেচ প্রকল্পের আওতায় ৫টি সেচপাম্প বসানো হয়েছে। ফলে এ এলাকার ১৫০টি পরিবার উপকৃত হবে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) খুলনা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জামাল ফারুক জানান, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে প্রতি বছর কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়। বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা নিরসনে এ কর্মসূচির আওতায় ৩ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পটির জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাড়ে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। প্রকল্পের অর্থ দিয়ে বিল ডাকাতিয়ায় ১৮ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। খাল খননের ফলে শোলমারি স্লুইসগেট দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয়েছে। ৫০টি এলএলপি পাওয়ার পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮ হেক্টর জমি চাষাবাদের আওতায় এসেছে। তিনি বলেন, বিল ডাকাতিয়া এলাকার জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের। বিল ডাকাতিয়ার অনেকগুলো পকেট গেট আছে, যেগুলোর জলাবদ্ধতার কারণে কৃষকরা চাষাবাদ করতে পারে না। তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জলাবদ্ধতা নিয়ে এখানে কাজ করেছে। কিন্তু এসব থেকে এলাকাবাসী খুব বেশি সুফল পায়নি। ৫০টি এলএলপি পাওয়ার পাম্প স্থাপনের ফলে যেটা দিয়ে বিলের পানি নিষ্কাশন করে নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। ফলে গত অর্থ বছরে ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা সম্ভব হয়। সঙ্গে সবজি উৎপাদনও সম্ভব হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close