নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৭ আগস্ট, ২০২২

লেভেলক্রসিংয়ে সিগন্যাল মানেন না অনেকেই

রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফোনে কথা বলা থামছে না * সতর্কসংকেত বাজলেও দৌড়ে লাইন পার হন অনেকে * আছে গেটম্যানেরও দায়িত্বে অবহেলা * চট্টগ্রাম দোহাজারী রুটে অর্ধশতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ক্রসিং

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এফডিসির সামনের রেলগেট। ট্রেন আসছে। তীব্র শব্দে বেজে উঠেছে সাইরেন। নেমে গেছে লেভেলক্রসিং বার, কিন্তু থমকে যায়নি দুই পাশের সবকিছু; বরং চাঞ্চল্য যেন বেড়েছে একটু বেশি। এদিকে গেটে দুটি বার থাকার কথা, কিন্তু আছে চারটি। ট্রেন আসার আগে যখন বার নামিয়ে দেওয়া হয়, তখন উল্টো পাশ দিয়ে রিকশা, মোটরসাইকেল বা মাইক্রোবাসও এগিয়ে যায়- এ অবস্থা রাজধানীর বিভিন্ন রেলগেটের।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহীর মৃত্যুর পর দুটি বর্ণনা এসেছে সংবাদমাধ্যমে। কেউ বলছেন, সেখানে ক্রসিং বার ফেলা ছিল না, তবে রেলওয়ের দাবি, ক্রসিং বার ফেলে গেটম্যান নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। মাইক্রোচালক বার তুলে এগিয়ে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সেখানে কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা জানা যাবে তদন্তের পর। এদিকে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে রেলপথে ৯৭৪টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ১১৬টি হয়েছে লেভেলক্রসিংয়ে। এই ১১৬ দুর্ঘটনায় ১৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন এক হাজার তিনজন। লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার কারণে ৩১৪ জন আহত হয়েছেন।

মৃত্যুর দায় নিতে প্রস্তুত নয় রেল : রেল কর্তৃপক্ষের ভাবনা, রেলপথে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য রেল সরাসরি দায়ী নয়। রেল নিজস্ব পথে চলে, সড়কে নয়। আর অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর দায় রেল আর নেবে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, অবৈধ লেভেলক্রসিং দেখার দায়িত্ব রেলের নয়। রেল শুধু বৈধ লেভেলক্রসিং পরিচালনা করে থাকে।

জানতে চাইলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালন) সরদার শাহাদাত আলী বলেন, সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান অবৈধ লেভেলক্রসিং তৈরি করেছে তাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। সেগুলো বৈধ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেসব লেভেলক্রসিং রেলের নজরদারিতে চলে এলে দুর্ঘটনা কমবে।

মিরসরাইয়ে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার তিন দিন পর কারওয়ান বাজারের এফডিসি রেলগেট এলাকায় দেখা যায়, ট্রেনের সংকেত বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গেটের বার নামানোর পরও একটি মাইক্রোবাস উল্টো পাশ দিয়ে রেলগেটের সামনের দিকে ছুটছে। পরে উল্টো পাশ দিয়ে গেট পার হয়ে মাইক্রোবাসটি আবার প্রান্ত বদল করে চলে যায় গন্তব্যে।

গেটকিপার লিটন মিয়া বলেন, ‘আমাদের মূল সমস্যা হলো মানুষ সিগন্যাল অমান্য করে। আপনারা তো দেখলেন একটা মাইক্রোবাস কীভাবে চলে গেল। পাবলিককে আরো সতর্ক হওয়া উচিত। কিছু হইলেই বলে গেটম্যানের দোষ, কিন্তু পাবলিক তো কোনো সিগন্যাল মানতে চায় না। ট্রেন আসার সময় ব্যারিয়ার দেওয়া হলেও তা অনেকে মানেন না।’

লেভেলক্রসিংয়ের পাশের পানের দোকানদার মো. মারুফ বলেন, ‘এফডিসির সামনে একটা কাটা আছে ইউটার্নের মতো। ওই ফাঁক দিয়েই গাড়িগুলো অবৈধভাবে সামনে চলে আসে। যখন ট্রেনের সিগন্যাল দেয়, তখনো অবৈধভাবে গাড়ি এসে সুযোগ পেলেও আবার উল্টো দিকে চলে যায়।’

কারওয়ান বাজার মাইক্রোস্ট্যান্ডে কয়েকজন চালকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তারাও জানান উল্টো পাশ দিয়ে গেট অতিক্রমের চেষ্টার কথা। তাদের একজন আসাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সুযোগ পেলে অনেকে রাস্তা খালি পেয়ে টান দিয়ে চলে আসে। অনেকে আমরা সতর্ক, তবে চট্টগ্রামের ঘটনার পর সতর্ক থাকে অনেকে।’

আরেক চালক মো. শামীম বলেন, ‘আমি আসিনি। কেউ এলে আসতেই পারে।’

কারওয়ান বাজার এলাকাতেই রেললাইন ধরে হাঁটতে দেখা গেল কয়েকজনকে। হাঁটার সময় কেউ কেউ আবার মোবাইল ফোনে কথাও বলছিলেন। ট্রেন আসার সতর্কসংকেত বাজতে থাকলেও দৌড়ে লাইন পার হচ্ছেন, এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়।

তাদের একজন রহিম মিয়া। রেললাইন ধরে হাঁটার ঝুঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চলে আসছি, তবে রেললাইন দিয়ে যাওয়া তো অবশ্যই ঝুঁকির। এমনও হতে পারে যে, ট্রেন এলে সরে যাওয়ার সুযোগই পাব না।’

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন সম্প্রতি মানুষের এই অসচেতনতার বিষয়টি নিয়েই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘ট্রেন কাউকে ধাক্কা দেয় না। রেলপথে এসে অন্যরা দুর্ঘটনার কারণ হলে তার দায় রেল নেবে না।’

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ঢাকায় যে লেভেলক্রসিংগুলো আছে, সেখানে যে পথচারী ও অন্য যানবাহনের চালক, উভয় পক্ষই চরম অধৈর্য। রেলের দুর্ঘটনার কারণ একটি হলো লাইনের দুই পাশে অবৈধ স্থাপনা। এ কারণে সেখানে পথচারীর যাতায়াত বেশি হয়। যেখানে হাটবাজার থাকবে, সেখানে রেলে কাটা পড়া মানুষ বেশি হবেই। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো ঢাকায় লেভেলক্রসিংয়ে প্রায় দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ জোড়া ট্রেন চলাচল করে। আমরা গবেষণায় দেখেছি, এতে সারা দিনে সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা দেরি হয়, যার কারণে যানজটও হয়। এ কারণে যাত্রীদের মধ্যে ধৈর্যচ্যুতি হয়। পথচারীদের জন্য ফুটওভারব্রিজ, অযান্ত্রিক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করার পর গেটম্যান দিয়ে রেললাইন নিয়ন্ত্রণ করা আধুনিক যুগে হবে না। এ জন্য লাগবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি।’

এদিকে, পটিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি নুরুল ইসলাম জানান, চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথে অর্ধশতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ লেভেলক্রসিং রয়েছে। ফলে যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রাম জানালিহাট স্টেশন থেকে শুরু করে দোহাজারী স্টেশন পর্যন্ত যেসব লেভেলক্রসিং রয়েছে তা এক প্রকার অরক্ষিত। গেটম্যানদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনেও অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। গেটম্যানরা ইচ্ছামতো দায়িত্ব পালন করেন বলে অভিযোগ। এ রুটে বর্তমানে তেলের ওয়াগন ছাড়াও যাত্রীবাহী এক জোড়া ডেমু ট্রেন প্রতিদিন চলাচল করে থাকে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন ১৯৩১ সালে নির্মাণকাজ করা হয়। এরপর থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পকাজ চলমান। চট্টগ্রাম-দোহাজারী পর্যন্ত যেসব লেভেলক্রসিং রয়েছে তা দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ। দোহাজারী স্টেশন, হাশিমপুর, খান হাট, কাঞ্চননগর, খরনা, চক্রশালা, পটিয়া, খানমোহনা, ধলঘাট, বেঙ্গুরা, গুমদন্ডী ছাড়াও চট্টগ্রাম জানালিহাট ও ষোলশহর স্টেশন এলাকায় দিন দিন বাড়ছে অবৈধ লেভেলক্রসিং। এর মধ্যে চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ব্রিক ফিল্ড পয়েন্ট, কসাইপাড়া পয়েন্ট, আব্বাসপাড়া, রৌশন হাট দুটি পয়েন্ট, বিজিসি ট্রাস্ট এলাকা, পটিয়ার মুজাফরাবাদ, খরনা স্টেশন, ভাইয়ারদিঘী পয়েন্ট, বাহুলী, দক্ষিণ ভুর্ষি, ডেঙ্গাপাড়া ও বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখিলসহ অর্ধশতাধিক পয়েন্টে অবৈধ লেভেলক্রসিং রয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নের শ্রীমাই এলাকায় প্রতিদিন শ্রীমাই খাল থেকে বালু উত্তোলন করে পিকআপসহ বিভিন্ন পরিবহনে রেলপথকে অবৈধভাবে ব্যবহার করছে। ফলে যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

কাঞ্চননগর স্টেশনের স্টেশন মাস্টার কাঞ্চন ভট্টচার্য্য জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে চন্দনাইশ এলাকায় ৫টি অনুমোদিত লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে ৩টিতে গেটম্যান রয়েছে। যারা অবৈধভাবে রেলপথ ব্যবহার করে চলাচল পথ সৃষ্টি করেছে তাদের একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছে।

পটিয়া রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার নেজাম উদ্দিন জানিয়েছেন, রেলপথ দখল করে যারা চলাচল করছে, তাদের বিষয়ে এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close