বিবিসি

  ১৪ অক্টোবর, ২০১৮

মুম্বাইয়ে আচমকা ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ খোঁজার হিড়িক

ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে আবার নতুন করে বাংলাদেশি তাড়ানোর হিড়িক পড়েছে। দেশটির আসাম রাজ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি নিয়ে তুমুল বিতর্কের মধ্যেই দেশের আরো নানা প্রান্তে অবৈধ বিদেশিদের শনাক্ত করার দাবি তুলছে বিজেপিসহ নানা রাজনৈতিক দল।

এই পটভূমিতেই আরো একবার আক্রমণের নিশানায় মুম্বাইয়ের কথিত অবৈধ বাংলাদেশিরা, যাদের দেশ থেকে তাড়ানোর দাবি উঠছে প্রকাশ্যেই।

কিন্তু এই ইস্যু নিয়ে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী কি আদৌ ভাবিত, না কি দেশে ভোটের আগে শ্রমজীবী এই গরিব মানুষগুলোকে আরো একবার রাজনৈতিক বলিরপাঁঠা বানানোর চেষ্টা চলছে? আরব সাগরের তীরে নতুন করে এই বাংলাদেশি তাড়ানোর ডাক ওঠায় শহরের বাংলাভাষী মুসলিমরাই বা কী বলছেন? মুম্বাইতে এর খোঁজখবর নিয়েছে বিবিসি। মুম্বাইয়ের দক্ষিণতম প্রান্তে চার্চগেট স্টেশন থেকে ছাড়া যে লোকল ট্রেনগুলো শহরের লাইফলাইন হিসেবে কাজ করে, তার অনেকগুলোরই রুটের একেবারে শেষপ্রান্তে শহরতলির ভায়ান্দার স্টেশন। আর সেই স্টেশন থেকে একটু দূরেই শহরের গরিবগুর্বো মানুষের এক বিশাল কলোনি, লোকের মুখে মুখে যার নাম ‘বাংলাদেশ বস্তি।’ সম্প্রতি ভায়ান্দারের এই বস্তির নাম উঠে এসেছে দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবের আলোচনাতেও।

শাসক বিজেপির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এমপি বিনয় সহস্রবুদ্ধ জানান, ‘সুদূর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য লোকজন অবৈধভাবে ভারতে ঢুকে ভায়ান্দারে পাড়ি দিচ্ছে। মুম্বাইয়ের আশপাশে টিলা-জঙ্গলগুলো দখল করে তারা গড়ে তুলছে বসতি, চালাচ্ছে নানা বেআইনি ধান্দা। এমন কী পুলিশ হানা দিতে গেলেও তাদের পাথর ছুঁড়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে এই বাংলাদেশিরা!’ বিজেপির এই দাপুটে নেতার হুশিয়ারি, অবৈধ বাংলাদেশির সমস্যা শুধু আসামের নয়, মুম্বাইসহ গোটা দেশেই তা ‘টাইম বোমার মতো টিক-টিক’ করছে। তার দলের সভাপতি অমিত শাহ তো আরো একধাপ এগিয়ে ভারতে থাকা বাংলাদেশিদের কখনো ‘ঘুষপেটিয়া’ (অনুপ্রবেশকারী), কখনো ‘দীমক’ (উইপোকা) বলেও গালাগাল করছেন। কিন্তু যেমনটা তারা বলছেন, সত্যিই কি বাংলাদেশিরা ছেয়ে ফেলছেন মুম্বাই শহরতলির বস্তিগুলো? ভায়ান্দারের তথাকথিত ‘বাংলাদেশ বস্তি’তে খোঁজখবর করতে গিয়ে কিন্তু চমকের পর চমক। বস্তির বাসিন্দা ঊষা, মুকেশরা জানাচ্ছেন তাদের কলোনির নাম বাংলাদেশের নামে হলেও সেখানে একঘর বাঙালি পর্যন্ত নেই। বরং অন্য দেশের নামে কেন তাদের কলোনির নাম, সেটাই তাদের এতদিন ভাবিয়ে এসেছে। আরো পুরনো বাসিন্দাদের কাছে খোঁজখবর করতে গিয়ে জানা গেল, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে যখন পুরনো ঝোপড়পট্টি ভেঙে এই কলোনি গড়ে তোলা হয়, তখন বাংলাদেশ যুদ্ধে জেতার সম্মানেই কিন্তু বস্তির নামকরণ করা হয়েছিল বাংলাদেশের নামে। কিন্তু না, কোনোদিন কোনো বাঙালি এই তল্লাটে কখনোই ছিল না। অথচ এই ‘বাংলাদেশ বস্তি’ নামটা ব্যবহার করেই কথিত অবৈধ বিদেশিদের বিরুদ্ধে মুম্বাইয়ের আবেগকে খুঁচিয়ে তুলতে চাইছেন বিজেপি নেতারা।

ভায়ান্দারের এই বাংলাদেশ বস্তি থেকে কয়েক মাইল দূরেই বিশাল গ্রামজুড়ে আরএসএস-এর থিংকট্যাংক তথা এনজিও ‘রামভাউ মহালগি প্রবোধিনী’র সদর দফতর। অবৈধ বাংলাদেশিরা মুম্বাইয়ের অর্থনীতিতে কী ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে বিশদ গবেষণার জন্য একটি ফেলোশিপও চালু করছেন তারা। ওই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক রবীন্দ্র সাঠে মনে করেন এই ইস্যুতে কোনো আপস করারই অবকাশ নেই।

সাঠে বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের সঙ্গে বৈষম্য করতে চাই না। কিন্তু অবৈধ বাংলাদেশিদের প্রশ্নটা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত আর সেটাকে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বেই রাখা উচিত।’

কলানগরের আজিম শেখ বলেন, ‘আজকাল খুব একটা সমস্যা নেই। আর বাংলাদেশি আছে খবর পেলে আশপাশের বাড়িই ইঙ্গিত দিয়ে দেয়, তখন এসে ধরপাকড় করে। সবাই তো আমরা এখন পেপার (কাগজপত্র) নিয়েই ঘোরাফেরা করি! বান্দ্রায় নার্গিস দত্তের নামাঙ্কিত এই কলোনিতেও আছেন বহু বাঙালি মুসলিম। বান্দ্রা-চার্চগেট রুটের নিত্যযাত্রীরা বলেন, ‘গরিব মানুষ রুটি রুজির সন্ধানে আসে, কী আর বলা যায়?’ বাংলাদেশিরা অনেকেই যে কলকাতা দিয়ে ঢুকেন সেখানে ভারতের নাগরিক পরিচয়পত্র বানিয়ে নিয়ে মুম্বাইতে চলে আসেন, সেটাও তারা জানেন। কিন্তু শহরে যারা পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আছেন, তারাও কোনোদিন দেখেননি এই বাংলাদেশিরা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করছেন। মুম্বাইয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত বাঙালিদের একজন, কবি-সাংবাদিক-চিত্রনির্মাতা ও শিবসেনার সাবেক এমপি প্রীতীশ নন্দী সটান জবাব দেন, ‘একেবারেই না!’ নরিম্যান পয়েন্টে নিজের অফিসে বসে মি নন্দী বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আসলে ভোটের জন্য মাঝে মাঝে কিছু কিছু পার্টি চেঁচামেচি করে এই ইস্যুটা নিয়ে। কারণ তারা জানে, যদি ঘৃণা ছড়ানো যায় তাহলে সেটা রাগের জন্ম দেবেÑ আর সেই রাগটা নাগরিকদের ভোটিং প্যাটার্ন বদলে দেবে।’ আবার মুম্বাইয়ের পোয়াই-তে আকাশছোঁয়া বহুতল সোসাইটিগুলোতে যারা গৃহকর্মীর কাজ করেন, তাদের অনেকেই যে আসলে বাংলাদেশি, তা নিয়ে যেমন কোনো সন্দেহই নেই, এমনই এক ফ্ল্যাটের মালকিন পারমিতা ভট্টাচার্যর।

তিনি বলেন, ‘প্রথম সন্দেহটা হয় নাম থেকেই, কারণ টিপিক্যাল বাঙালি মুসলিম নাম। তারপর যখন বলে তারা বনগাঁ-মসলন্দপুর-বসিরহাট থেকে এসেছে, তখন মোটামুটি ধরেই নেওয়া যায় সীমান্ত পেরিয়েই ভারতে ঢুকেছে তারা।’ মুম্বাইয়ের অসংখ্য ফ্ল্যাটে গৃহপরিচারিকা বা রাঁধুনির কাজে এদের সাধারণত নিয়োগ করা হয় বিভিন্ন বেসরকারি এজেন্সির মাধ্যমে; সেই এজেন্সির লোকজনই তাদের পরিচয়পত্র বা আধার কার্ড বানিয়ে দেয় বলে জানান ভট্টাচার্য।

মুম্বাই এটাও জানে, শহরে যতক্ষণ কাজের সুযোগ আছে, ততক্ষণ বাইরে থেকে মানুষের ঢল ঠেকানো যাবে না। ভারতে রয়্যাল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ডের সাবেক প্রধান ও মুম্বাইয়ের রাজনীতিবিদ মীরা সান্যাল মনে করেন, এই সিস্টেমটাকেই আসলে ‘গেুলারাইজ’ করা বা বৈধতার আওতায় আনা দরকার।

মুম্বাইতে বিদেশি শ্রমিকদের জন্য ওয়ার্ক পারমিট চান মীরা সান্যাল। তার কথায়, ‘মুম্বাই শহরটাই তো গড়ে তুলেছে বাইরে থেকে আসা লোকজন। শুধু ভারতের নয়, ভারতের বাইরে থেকেও এখানে এসেছে আর্মেনিয়ান ইহুদিরা, পার্সি বা ইরানিরা। জল যেমন নিজের লেভেল খুঁজে নেয়, তেমনি কাজের সুযোগ থাকলে বাইরের মানুষ মুম্বাইতে আসবেইÑ বাংলাদেশিরা ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন? তবে আরএসএস ভাবধারার গবেষক রাভি পোখর্না আবার মনে করেন, ঢিলেঢালা সীমান্ত দিয়ে যেভাবে বিদেশিরা এতদিন ভারতে ঢুকেছে, সেই জিনিস চলতে থাকলে ভারতের স্থিতিশীলতাই বিপন্ন হয়ে পড়বে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close