নূর ইসলাম নয়ন, দিনাজপুর

  ১২ অক্টোবর, ২০১৮

স্বপ্ন ছুঁয়েছেন সজিব রায়

দারিদ্র্য ও পদে পদে বাধার পাহাড় আটকাতে পারেনি সজিব রায়ের স্বপ্নকে। এবারের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন সজিব চন্দ্র রায়। গরিব কাঠুরিয়া বাবা এবং দিনমজুর মায়ের সন্তান হয়েও এবারের মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অসামান্য সাফল্য লাভ করে এলাকার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন অদম্য মেধাবী এই শিক্ষার্থী। চরম দারিদ্র্য থামাতে পারেনি তার শুভ ইচ্ছা এবং মেধাশক্তি। তিনি সত্যিই স্বপ্ন ছুঁয়েছেন।

মেডিকেলে কৃতিত্বের সঙ্গে ভর্তির সুযোগ পেয়েও এখন তার স্বপ্ন টাকাকড়ির অভাবে দুঃস্বপ্ন হওয়ার পথে। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ১১ নং মরিচা ইউনিয়নের গ্রাম কাঠগড় রাজাপুকুর। এই গ্রামেই একেবারে খুব গরিব পরিবারে ২০০০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম সজিব চন্দ্র রায়ের। বাবা মনোধর চন্দ্র রায় সংসারের ভরণপোষণ নির্বাহের জন্য একসময় রিকশাভ্যান চালাতেন। ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে সেই রিকশাভ্যান বিক্রি করে এখন শুধু কাঠুরিয়ার কাজ করেন। এরপরও সংসারের আহার জোগাড় না হওয়ায় মা চারুবালা রায়কে যেতে হয় কৃষিশ্রমিক হিসেবে দিনমজুরের কাজ করতে। দারিদ্র্যের এই চরম অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে এবং এই অভিশাপ কাটিয়ে সমাজে কিছু দিতে সজিব চন্দ্র রায় স্বপ্ন দেখেন বড় হয়ে চিকিৎসক হওয়ার। কৃতী শিক্ষার্থী সজিব চন্দ্র রায় বলেন, চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে একবার সে চরম অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন তারা বাবা-মা। অর্থাভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারছিলেন না গরিব বাবা-মা। তখন থেকে তার ইচ্ছাÑ বড় হয়ে চিকিৎসক হওয়ার। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে চিকিৎসক হওয়ার অদম্য ইচ্ছা নিয়েই লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ২০১০ সালে বাড়ির পার্শ্ববর্তী কাঠগড় আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় বীরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে প্রথম হন তিনি। স্থানীয় গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে জেএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫সহ ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি এবং একই বিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেন। ২০১৮ সালে সৈয়দপুর সরকারি টেকনিক্যাল কলেজ থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন সজিব। সজিবের বাবা মনোধর চন্দ্র রায় জানান, জমি বলতে বাড়ির ভিটাটুকু আর কিছুই নেই তার। আগে রিকশাভ্যান চালাতেন। পরবর্তীতে ছেলের লেখাপড়ার জন্য সংসারের একমাত্র সম্বল রিকশাভ্যানটি বিক্রি করে দেন। এখন কাঠুরিয়ার (গাছ কাটা) কাজ করে সংসার চালান তিনি। ছেলের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ও ইচ্ছা মাঝে মাঝে তাকে বিমর্ষ করে। এমন অভাবের এই সংসারে কী করে এটা সম্ভব? ডাক্তারি পড়ার টাকা কী করে জোগাড় করবেন? এখন এ চিন্তাই বাবা-মায়ের। এ জন্য ছেলে ও পরিবারের এই স্বপ্ন বাস্তরে রূপ দিতে দেশবাসী ও বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। সজিবের মা চারু বালা রায় জানান, মারাত্মক অভাবের সংসারে স্বামীর রোজগার দিয়ে নিয়মিত উনুন (চুলা) জ্বালাতে গিয়ে হোচট খেতে হয়। এ জন্য এক ছেলে ও এক মেয়ের লেখাপড়া আর সংসারের বাড়তি খরচ মেটাতে তিনিও বের হন দিনমজুরের কাজ করতে। কৃষিশ্রমিক হিসেবে দিন-রাত মাঠে পরিশ্রম করে সংসারের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করেন তিনি। ছেলে মেডিকেল কলেজে কৃতিত্বের সঙ্গে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর তিনি বলেন, ‘ভগবান যাতে হামার শেষ ইচ্ছা পূরণ করেন।’

সজিবের ছোটবেলা থেকেই চিকিৎসক হওয়ার যে অদম্য ইচ্ছা সেই ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য উৎসাহ ও সহযোগিতা করেন তার শিক্ষক জহুরুল ইসলাম মানিক ও মো. হেলাল উদ্দীন। মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার খবর পেয়ে গত সোমবার সজিবের বাড়িতে আসেন এ দুই শিক্ষক। সজিবের ওই শিক্ষকরা জানান, এরকম মেধাবী শিক্ষার্থী সমাজে খুবই বিরল। তবে ছোটবেলা থেকেই তার যে প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও মেধা, তাতে তারা মনে করেছিলেন, বাবা-মায়ের দারিদ্র্য তার এই ইচ্ছা শক্তিকে কখনোই থামাতে পারবে না। আজ তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। মানুষ ভিড় করে সজিবের গ্রামের বাড়ি। এ সময় প্রতিবেশীরা আনন্দে মিষ্টিও বিতরণ করেন। বেড়া ও খড়ের চালে নির্মিত জরাজীর্ণ বাড়িতে গত দুদিন ধরে ভিড় করে হাজারো মানুষ। প্রতিবেশীসহ সকলেই এ সময় প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, গ্রামের গরিব পরিবারের সন্তান হলেও সজিব একদিন বড় চিকিৎসক হয়ে অবহেলিত এই এলাকার মানুষের চিকিৎসা সেবায় অনন্য ভূমিকা পালন করবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close