মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

  ২৯ এপ্রিল, ২০২৪

বন্যপ্রাণীর বন্ধু শাহিন

বাড়ির পাশে জমিতে আখের চাষ হয়। আখখেতে খরগোশসহ নানা প্রাণী আসা-যাওয়া করে। এই প্রাণীগুলো শিকারে মেতে উঠে একদল পাষ-। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই শিকারিদের বন্যপ্রাণী শিকার রোধে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন মো. শাহিন সরকার। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স পড়ছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি বন্যপ্রাণী, পরিবেশ, প্রকৃতি নিয়ে তার কাজ সবার নজর কেড়েছে। পরিবারে আছে বাবা, মা ও বড় বোন। সদর চুয়াডাঙ্গার তিতুদহ ইউনিয়নের ৬২ নম্বর আড়িয়া গ্রামে তার বাড়ি।

বাবা অনুপ্রেরণা

শাহিনের বাবা একজন প্রকৃতি?প্রেমী। প্রাণীদের জন্য তার খুব মায়া। তিনি একবার একটি অসুস্থ ঘোড়া কিনে ?এনে সেবা, যত্ন, চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে ছেড়ে দেন। এ বিষয়টা শাহিনের জন্য পরে ভীষণ অনুপ্রেরণা হয়ে দেখা দেয়। শাহিন বলেন, ‘আমার বাবার কাজ আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়।’

ও একটা পাগল

এই ছেলে একটা পাগল। ভবঘুরে। খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। এমন নানা রকম কথা মানুষ বলাবলি করেছে। শুরুর দিকে এই কথাগুলোতে শাহিনের মন খারাপ হতো। তবে তিনি এসব পাত্তা দেননি। যারা আগে এমন কথা বলেছে। কালস্রোতে তারাই এখন শাহিনের কাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই মানুষগুলো ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। এটাই অনেক বড় পাওয়া বলে মনে করেন তিনি।

২০০ প্রাণী উদ্ধার

২০০টিরও বেশি অসুস্থ বন্যপ্রাণী সেবা দিয়ে সুস্থ করে বনে ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খরগোশ, গুইসাপ, প্যাঁচা, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। কেউ কোথাও অসুস্থ বন্যপ্রাণী পেলে তার ডাক আসে। তিনি ছুটে যান। সেবা দিয়ে সুস্থ করে পরে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করেন। আবার শতাধিক বন্যপ্রাণী উদ্ধার কার্যক্রমে তার কার্যকর অংশগ্রহণ ছিল।

বন্যপ্রাণী রক্ষায় সচেতনতামূলক কাজ

বন্যপ্রাণী শিকার রোধই নয়। শাহিন বন্যপ্রাণী বিষয়ে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন। তিনি চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, চায়ের দোকান ও হাটবাজারে গিয়ে লিফলেট, মাইকিং করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি বন্যপ্রাণী সম্পর্কে তথ্যমূলক পোস্ট দেন। যাতে মানুষ সচেতন হতে পারে। তিনি ২০২২ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রেস ক্লাবে চ্যানেল আইয়ের প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত হয়।

মানবতার জন্য

প্রথম দিকে কাছের বন্ধুদের নিয়ের কাজ করলেও একসময় সংগঠন করার তাগিদ অনুভব করেন। শাহিন ২০১৮ সালে ‘মানবতার জন্য’ নামে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যানারে কাজ শুরু করেন। এই সংগঠন প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করার পাশাপাশি গরিব, দুস্থ, অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে। বর্ষাকাল এলে গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফলদ ও বনজগাছ উপহার দেয়।

বন্যপ্রাণী প্রকৃতির অলংকার

বন্যপ্রাণী প্রকৃতির অলংকার। আমাদের দেশ যেমন আমাদের মায়ের মতো, ঠিক তেমনি যদি মায়ের হাতে গলায় কানে অলংকার না থাকে তাহলে মায়ের দিকে তাকালে শূন্যতা অনুভব করা যায়। আর আমাদের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য হচ্ছে আমাদের দেশ মায়ের অলংকার। এগুলো না থাকলে আমাদের আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার ভেতর পড়ে যাবে। আর এ জন্য বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করি, বলেন শাহিন।

১৫০০০ তালবীজ রোপণ

তালগাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তালগাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে। শাহিনের নেতৃত্বে মানবতার জন্য সংগঠনের কর্মীরা এই মৌসুমে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ফার্ম থেকে বলদিয়া কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ৬৩ নম্বর আড়িয়া গ্রামের মাঠ থেকে গোলাপ নগর মোড় পর্যন্ত মাত্র আট দিনে ১৫০০০ তালবীজ রোপণ করেছে। এর আগে ২০২০-২১-২২ সালে তারা ২০০০ হাজার তালবীজ রোপণ করেছিল।

একটুর জন্য প্রাণে বেঁচেছেন

বন্যপ্রাণী উদ্ধার অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কারণ এসব প্রাণী যারা শিকার করেন। তারা নানা রকম দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত থাকেন। ২০২০ সালে তিন খরখোশ শিকারিকে ধরে ফেলেন শাহিনের দল। পরে তারা আর বন্যপ্রাণী শিকার করবে না- এমন মুচলেকা দেওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়। দিন পনেরো পরে ওই শিকারিরা ফোনে খবর দেয়, ওমুক জায়গায় পাখি শিকার হচ্ছে। শাহিন সেখানে ছুটে যান। তখন ওই শিকারিদের হাতে নানা রকম অস্ত্র ছিল। শাহিন বলেন, সুযোগ পেয়ে আমাকে মেরে ফেললেও কেউ দেখত না। পরে অবশ্য তারা কিছু বলেনি। সবাই মিলে পাখি শিকার সেবারের মতো বন্ধ করেছিলেন।

বোঝালে কাজ হয়

বন্যপ্রাণী বিষয়ে মানুষকে বোঝালে পারলে ভালোই কাজ হয়। একবার এক লোক পুকুরের চারপাশে লোহার তার ব্যবহার করত। তারে থাকত বিদ্যুৎ। ফলে শিয়ালসহ যেকোনো বন্যপ্রাণী বিদুৎপৃষ্ট হয়ে মারা যেত। একজন মানুষও ঘাস কাটতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে আহত হয়। এ খবর জানতে পেরে শাহিন সেখানে ছুটে যান। ওই লোককে বুঝিয়ে শুনিয়ে এই অপকর্ম করা বন্ধ করেন।

অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে চাই

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ প্রতিটি জেলাকে পাখি বা বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে চাই। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিটি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সভা-সেমিনার করতে চাই। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল তৈরিতে প্রতিটি অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা ও সামাজিক বনায়ন তৈরি করা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close