প্রতীক ইজাজ ও বদরুল আলম মজুমদার

  ২৯ মে, ২০১৮

ইফতার রাজনীতি লক্ষ্য নির্বাচন

চলতি বছরের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সে হিসেবে নির্বাচনের বাকি মাত্র সাত মাস। নির্বাচনী হাওয়া বইছে দেশে। ব্যস্ত সময় কাটছে রাজনৈতিক দলগুলোর। এরই মধ্যে চলে আসা রমজান মাস সেই নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। তার ওপর নির্বাচনের আগে এটাই শেষ রোজা। সুতরাং এ সুযোগকে হাতছাড়া করতে নারাজ রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নির্বাচন ও রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মহলগুলোও। ফলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো দল ও সংগঠন আয়োজন করছে ইফতার পার্টির। আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যোগ দিচ্ছেন রাজনীতিক, কূটনীতিক, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশাজীবীর মানুষ। নিজ দলের নেতাকর্মীদের বাইরেও অংশ নিচ্ছেন সমমনা দল ও সংগঠনের নেতারাও।

একদিকে যেমন আয়োজন করা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন পার্টির; তেমনি ইফতার শুরুর আগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্বাচনী আলোচনা-সেমিনার। দলীয় বক্তব্যও রাখছেন নেতারা। আলোচনায় উঠে আসছে জাতীয় নির্বাচন ও দলের নির্বাচনী প্রচারণা। ফলে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল, সংগঠন বা ব্যক্তিবিশেষের ইফতার পার্টির ওপরও। কে কার পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন, তার হিসাব যেমন রাখা হচ্ছে; তেমনি কে কোথায় কী বক্তব্য রাখছেন, আলোচনা হচ্ছে তা নিয়েও। এসব ইফতার পার্টিতে দেওয়া বক্তব্য ধরে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতারা।

শুধু রাজধানীতেই নয়; ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও জমে উঠছে নির্বাচনী রাজনীতি। স্থানীয়ভাবে নেতাকর্মীরা আগামী নির্বাচনের গণসংযোগের মাধ্যম হিসেবে ইফতার পার্টিকে কাজে লাগাচ্ছেন। আর মনোনয়নপ্রত্যাশী কেন্দ্রীয় নেতারা এতে বিশেষভাবে অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন তৃণমূলে সংগঠনকে চাঙা করতে চাইছে দলগুলো; তেমনি নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারেÑ এমন মহলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ও সমঝোতার বোঝাপড়াটাও সেরে নেওয়া হচ্ছে কৌশলে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ইফতার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মূলত দলের ঐক্য সুদৃঢ় করা, ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়ানো ও কর্মীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রের পাশাপাশি মহানগর, জেলা, উপজেলা এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ে চলছে ইফতার পার্টির আয়োজন।

বিশেষ করে ইফতার পার্টি নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় কাটছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির। পিছিয়ে নেই জাতীয় পার্টিসহ অন্য রাজনৈতিক দলও। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ইতোমধ্যেই একাধিক ইফতার কর্মসূচি সম্পন্ন করেছেন। তালিকায় রয়েছে আরো কিছু ইফতার পার্টি। অন্যদিকে দুর্নীতি মামলায় কারাগারে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ছাড়াই দলটি এরই মধ্যে কয়েকটি ইফতার পার্টি সম্পন্ন করেছে।

এমনকি ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে নির্বাচনে জোট রাজনীতির আভাসও মিলছে। বিএনপিসহ সংসদের বাইরে থাকা অন্য দলগুলোর নেতাদের একই পার্টিতে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে গত রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার আমন্ত্রণে দলটির ইফতার পার্টিতে অংশ নেন সংসদের বাইরে থাকা কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা। এর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টি বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি আ স ম আবদুর রব, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল প্রমুখ। ওই ইফতার পার্টির আগে ‘গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই’ শীর্ষক সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সরকারের সমালোচনা করা হয়।

আওয়ামী লীগের কৌশল রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা : প্রথম রোজায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচ টি ইমাম ও সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী ইফতার করেছেন জাতীয় পার্টির আমন্ত্রণে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইফতার করেন আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে। শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও চলছে দলবদ্ধ রাজনৈতিক ইফতার। একই দিন দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত দোয়া ও ইফতার মাহফিলে অংশ নেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এর বাইরেও দলের অন্য শীর্ষ নেতারাও নিজ নিজ এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ইফতার করছেন।

দলীয় সূত্রমতে, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ইফতার আয়োজন না করলেও দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে ছয় দিন ইফতার কর্মসূচি রেখেছেন। এর মধ্যে ২১ মে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, এতিম, প্রতিবন্ধী শিশু ও আলেমদের সঙ্গে; ২৩ মে বিচারপতি, কূটনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তা (সামরিক-বেসামরিক) এবং গতকাল পেশাজীবীদের সঙ্গে ইফতার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ২ জুন আত্মীয়-পরিজন, ৪ জুন রাজনৈতিক নেতা এবং ৬ জুন আইনজীবীদের সঙ্গে ইফতার করবেন প্রধানমন্ত্রী। এসব কর্মসূচিতে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও উপস্থিত থাকছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মাসব্যাপী ইফতারের আয়োজন থাকবে মহানগর আওয়ামী লীগ ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোও ইফতার কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকবে।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, রমজান মাসে রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও দলের নেতাকর্মীদের আয়োজনে বিভাগীয়, জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ইফতারের আয়োজন করা হয়। এর মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি অনির্ধারিত আলোচনায় দলের বর্তমান অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। রমজানে রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও ইফতারে অংশ নিয়ে আমরা দলকে সুসংগঠিত করার চেষ্টা করব।

রমজান কাজে লাগাতে চায় বিএনপি : বিএনপি রমজান মাসকে নির্বাচনী ও দলীয় রাজনীতিতে কাজে লাগাতে চায়। এজন্য দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা ইফতার আয়োজনের দিকে নজর দিয়েছেন। দলের নেতারা বলছেন, প্রকাশ্যে কোনো সভা-সমাবেশ আয়োজন করতে না পারলেও রমজান মাসে সে রকম বাধা পাচ্ছেন না। তাই ইফতারকে উপলক্ষ করে দলের কর্মী যোগাযোগ ও নির্বাচনী রাজনীতির গ্রান্ডক ওয়ার্ক করে রাখতে চায়। এজন্য দলের প্রত্যেক মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা দলের প্রতিটি ইউনিটে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করপ্রণ। দলের মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে ইফতার আয়োজনের মাধ্যমে কর্মী যোগাযোগ বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে রোজার আগেই।

বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, দল ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠন সবচেয়ে কঠিন কাজ তা গত দুই বছরে আঁচ করা গেছে। বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েও সাংগঠনিক পুনর্গঠন শেষ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন আর সময় নেই। রমজানের পরে চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতেই হবে। এজন্য সব জেলা কমিটি ও অঙ্গ দলের বিশেষ করে আন্দোলন সফল করার হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত সংগঠনগুলোর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে রমজান মাসেই। তাই অন্য যেকোনো রমজান মাসের চেয়েও এবারের মাসটি বিএনপির জন্য একটি ব্যস্ত সাংগঠনিক মাস। কারণ এ মাসে দলটি সেরে নিচ্ছে আন্দোলনে নামার যাবতীয় প্রস্তুতিও।

জানা গেছে, এখন পর্যন্ত তিনটি ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছে বিএনপি। এর মধ্যে গত শুক্রবার বিএনপির উদ্যোগে প্রথম রোজায় এতিম ও আলেমদের সম্মানে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছিল রাজধানীর ইস্কাটনের লেডিস ক্লাবে। সেখানে রাজধানীর কয়েকটি এতিমখানা ও মাদরাসা থেকে শতাধিক এতিম শিক্ষার্থী অংশ নেয়। দ্বিতীয় রোজায় রাজনীতিবিদদের সম্মানে একই স্থানে ইফতার আয়োজন করে বিএনপি। সেখানে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে রাজনীতিবিদদের সম্মানে এবারের ইফতারে আওয়ামী লীগ ও ১৪দলীয় জোটের কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আর তৃতীয় রোজায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সম্মানে রাজধানীর একটি হোটেলে ইফতার আয়োজন করে দলটি।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, রমজান মাসে সবাই রাজনীতিটাকে একটু দূরে রেখে ধর্মকর্ম করতে চান। তবে রাজনীতির তো আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ছুটি হয়ে যায় না। এ মাসে ইফতার পার্টি ও বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকা- চলে। আর এর মধ্য দিয়েই সাংগঠনিক কর্মকান্ডও চলবে এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলনের কর্মসূচিও থাকবে।

অন্যান্য দলও ব্যস্ত : আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে জাতীয় পার্টিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো সরব ইফতার মাহফিল নিয়ে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘রমজান মাসের পবিত্রতা দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার একটি বন্ধন সৃষ্টি করি। মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে আমার একসঙ্গে বসে ইফতার করি।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist