তানভীর সালেহীন ইমন

  ১৪ আগস্ট, ২০২২

বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির দর্শন

বঙ্গবন্ধু মানেই মানসপটের ক্যানভাসে আঁকা হিমালয়ের মতো অবিচল ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠ এবং দূরদর্শী এক মহান নেতা, যার নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি এবং নির্দেশনায় অর্জন করি আমাদের আরাধ্য স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে করেছেন মর্যাদাপূর্ণ ও গতিশীল। যে সময় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, পৃথিবী তখন পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক দুই পরাশক্তির টানাপড়েনে দুই মেরুতে বিভক্ত। তাই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশকে তিনি এই দুই পৃথক বলয় থেকে মুক্ত রেখে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলবেন এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বঙ্গবন্ধু তার পররাষ্ট্রনীতিতে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয় মূলমন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান এবং তৃতীয় বিশ্ব ও জোটনিরপেক্ষ নীতিকে সমর্থন দিয়ে বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়টি প্রতীয়মান হয়।

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ লাহোর বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি বামপন্থিও নই দক্ষিণপন্থিও নই, আমি দেশবাসীর স্বার্থের পক্ষে। ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্র দর্শনে বলেছিলেন, আজ বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতার লড়াই সেই লড়াইয়ে আমরা কোনো মতে জড়িয়ে পড়তে পারি না। এজন্য আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণ বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত জনগণের যে সংগ্রাম চলছে সে সংগ্রামে আমরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা অনুযায়ীই প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রনীতি প্রণীত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলা। রাষ্ট্রীয় মূল চার নীতির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু সরকার তাই অনুসরণ করেছেন স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড ঘোষণা করেন। অর্থাৎ সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। চীন ও পাকিস্তান সে সময় অপপ্রচার চালিয়েছিল যে বাংলাদেশ কোনো স্বাধীন দেশ নয়, ভারতের অংশবিশেষ। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর দ্রুত এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেন। ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হয় মার্চের মধ্যে। ১৯৭১-এর আগে যারা দেশত্যাগ করেছিল তাদের ফেরত না আনা ও ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যেন প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারে, এ বিষয়ে তিনি ছিলেন বেশ সতর্ক। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিতে যে বিষয়গুলো প্রতীয়মান হয় : আত্মমর্যাদার পররাষ্ট্রনীতি, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও মৈত্রী, কোনো রাষ্ট্রের প্রতি অতি নির্ভরশীল না হওয়া, জোটনিরপেক্ষ নীতি, বৈদেশিক সাহায্য আদায়ের কূটনীতি, বিদেশি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তকরণের কূটনীতি, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান, বিশ্বের শোষিত মানুষের ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে সমর্থন দান, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আস্থা রাখা, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন।

সত্তর দশকের শুরুতে পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের মতো ভাষা ও কৃষিভিক্তিক দেশ সৃষ্টির অনুকূলে ছিল না। একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ কখনোই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া নিজেকে পুনর্গঠন করতে পারে না। বঙ্গবন্ধু এই কঠিন বাস্তবতা অনুধাবন করে তার সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সাজিয়েছিলেন। তার সব প্রয়াস এবং চিন্তার কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের মর্যাদায় বাঙালি জাতিকে আত্মমর্যাদায় বলীয়ান করে গড়ে তোলা। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন বাংলাদেশকে ভারতের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত রাখা। পাকিস্তান-চীন বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গীভূত প্রদেশ হিসেবে যে অপপ্রচার চালিয়েছিল বঙ্গবন্ধু মাত্র ৯০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতের সৈন্য প্রত্যাহার করিয়ে তার সমুচিত জবাব দিয়েছেন। পৃথিবীর কোন দেশ থেকে স্বাধীনতার পর এত দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭০ বছর পরও জার্মান এবং জাপান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়নি। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য কূটনৈতিক সফলতা। আত্মমর্যাদাশীল বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা, বৈদেশিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও সাহায্য আদায়, আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ ও প্রতিনিধিত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য।

নিরপেক্ষতার পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সোভিয়েত রাশিয়া সফর করে এসেছি। সেখানে তাদের অকৃত্রিম আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সোভিয়েত নেতারা বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজে সার্বিক সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আমি ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জ, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিমা জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো এবং অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রসমূহ যারা আমাদের দিকে সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছেন, তাদের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে করছি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি জোটবহির্ভূত ও সক্রিয়। আমরা শান্তিকামী। আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতিতে বিশ্বাসী এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব সৃষ্টিতে আগ্রহী। দেশ গড়ার কাজে কেউ আমাদের সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করব কিন্তু সে সাহায্য অবশ্যই হতে হবে নিষ্কণ্টক ও শর্তহীন। আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সব জাতির সমমর্যাদার নীতিতে আস্থাশীল। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করবেন নাÑ এটাই আমাদের কামনা। ‘বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির স্বনির্ভরতা অর্জন ও বহির্বিশ্বে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকারের পাঠানো লিমোজিন গাড়িতে না চড়ে তিনি চড়লেন বাংলাদেশের অস্থায়ী মিশন প্রধানের ছোট গাড়িতে। তখন, ইন্দিরা গান্ধীর বিমান প্রেরণের প্রস্তাব গ্রহণ না করে ভারত সফরে তিনি যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা ছিল তার আত্মমর্যাদার বহিঃপ্রকাশ।

বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতি বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু বাস্তবসম্মত এবং বিচক্ষণ পররাষ্ট্রনীতি আমাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথ সুগম করেছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আস্থা এবং সুসম্পর্কের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ২৫ জানুয়ারি স্বীকৃতি প্রদান করে এবং তাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু কালক্ষেপণ না করে স্বীকৃতি এবং আমন্ত্রণের বার্তা সংবাদমাধ্যমে প্রচার করেন দেশে ও বিদেশে। তিনি জানতেন এই পরাশক্তির স্বীকৃতি আমাদের স্বাধীনতায় আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আরো ত্বরান্বিত করবে। ১৯৭২ সাল শেষ হতে না হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় ৫০টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। শুরুতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতি দাঁড় করালেও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কথা চিন্তা করে তিনি তার পররাষ্ট্রনীতিকে ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যমুখী করেছেন। এর ফলে বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশাতেই চীন এবং সৌদি আরব ছাড়া মুসলিম বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকেই স্বীকৃতি লাভ সম্ভব হয়।

বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশকে বিশ্বের ১১৬টি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ, ওআইসি, আইএমএফসহ প্রায় ৫০টি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। ৭০টির আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দ্বৈত সহযোগিতা চুক্তি ও স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় ৪০টির বেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান বাংলাদেশ সফর করেন। এটি ছিল বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম সাফল্য। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির দর্শনে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে সবার সঙ্গে কৌশলগত ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা হয়। তার অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির আলোকেই আজকের বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মর্যাদার আসনে উপনীত হয়েছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বঙ্গবন্ধু,পররাষ্ট্রনীতির দর্শন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close