আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ২৮ জুলাই, ২০২২

আনন্দ উচ্ছ্বাসে উদযাপিত হোক হিজরি নববর্ষ

সময়ের পরিক্রমায় বিদায় নিচ্ছে ১৪৪৩ হিজরি, দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর। আর দু’দিন পরেই উঁকি দেবে মুহাররমের নতুন চাঁদ। আর পহেলা মুহাররম হলো হিজরি নববর্ষ। হিজরি নববর্ষ মুসলিম উম্মাহর এক অনন্য উৎসব। আকাশের রূপালি তারাদের পায়ে তাই ঝলমলে আলোর নাচন। নদীর তরঙ্গ, ঝর্ণার জলধারা আর পাখিদের মিষ্টি কলতানে আগমনী সুর আহলান, সাহলান শাহরু মুহাররাম। এ সুরের মোহনায় দুলে ওঠে ফুলের বাগান। বাতাসে ছড়িয়ে দেয় আগরের ঘ্রাণ।

হিজরি সনের গোড়ার কথা : খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা) এর শাসনামলে ১৬ হিজরিতে প্রখ্যাত সাহাবী হজরত আবু মুসা আশআরী (রা) ইরাকত এবং কুফার গভর্নও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। একদা হজরত আবু মুসা আশআরী (রা) খলিফা হজরত ওমর (রা) এর কাছে এ মর্মে চিঠি লিখলেন যে, ‘আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সম্বলিত যেসব চিঠি আমাদের নিকট পৌঁছে, তাতে দিন মাস কাল না থাকায় কোন চিঠি কোন দিনের তা নিরূপণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদেরকে নির্দেশ কার্যকর করতে খুব কষ্ট হয়। অনেক সময় আমরা চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে বিব্রত বোধ করি।’

হজরত আবু মুসা আশআরী (রা) এর চিঠি পেয়ে হজরত ওমর ফারুক (রা) এ মর্মে পরামর্শ সভা আহ্বান করলেন যে, এখন থেকে একটি ইসলামি সন প্রবর্তন করতে হবে। সভার উপস্থিতির পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে হজরত ওমর (রা) ইসলামি সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। তবে কোন মাস থেকে বর্ষের সূচনা হবে তা নিয়ে পরস্পরের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কেউ মত পোষনণ করেন রাসুল (সা) এর জন্মের মাস থেকে, আবার কেউ বলেন ওফাতের মাস রবিউল আউয়াল থেকে বর্ষ শুরুর। আবার কেউ কেউ বলেন রাসুল (সা) এর হিজরতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। এভাবে মতানৈক্যের সৃষ্টি হলে হজরত ওমর (রা) বলেন, ‘হুজুর (সা) এর জন্মের মাস থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু করা যাবে না। কেন না খ্রিস্টানরা হজরত ঈসা (আ) এর জন্মেও মাস থেকেই খ্রিস্টাব্দের গণনা শুরু করেছি। তাই রাসুল (সা) এর জন্মের মাস থেকে সুচনা করা হলে খ্রিস্টানদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যাবে, যা মুসলমানদের জন্য অবশ্যই পরিতায্য। আবার হুজুর (সা) এর ওফাতের মাস থেকেও শুরু করা যাবে না। এতে হুজুর (সা) এর মৃত্যু ব্যথা আমাদের মাঝে বারবার উত্থিত হবে। পাশাপাশি অজ্ঞ যুগের মৃত্যুর শোক পালনের ইসলাম বিরোধী একটি কুপ্রথারই পুনরুজ্জীবন করা হবে। হজরত ওমর (রা) এর এই তাৎপর্যময় বক্তব্যকে হজরত ওসমান ও আলী (রা) সমর্থন করেন। অতঃপর বহু চিন্তা ভাবনার পর হজরত ওমর ফারুক (রা) হিজরতের বছর থেকেই ইসলামি ইসলামি দিনপঞ্জি গণনার সিদ্ধান্ত নেন। যা বর্তমান প্রায় দেড়শ কোটি মুসলমানের কাছে হিজরি সন বলে পরিগণিত। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা)-এর ঐতিহাসিক ‘হিজরত’ এর নামে নামকরণ করা এই হিজরি নববর্ষ আগমনে প্রকৃতির আয়োজনে কোনো কমতি নেই। কিন্তু আমরা? আমরা যারা মুসলমান; নিজেদের মুমিন দাবি করি, তাদের হৃদয় কি খুশির জোয়ারে ভরে ওঠেছে? যতটা আনন্দিত হই নিইউ ইয়ারে, যতটা উৎসবমুখর হই বাংলা নববর্ষে, হিজরি নববর্ষে কি ঠিক ততটা উচ্ছ্বসিত হয়েছি? আনন্দিত হওয়া তো পরের কথা, আমরা তো হিজরি বর্ষের দিন মাসের নামই জানি না। এ কেমন মুসলমান আমরা! নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, তাহজিব-তামাদ্দুনের চর্চা না করে ভিন দেশ আর ভিন ধর্মের কৃষ্টিতে ডুবে আছি। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আবার নিজেকে মুসলিম বলেও দাবি করছি। অথচ রাসুল (সা) বলেছেন, ‘সে আমার উম্মত নয়, যে অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা বজায় রাখে। তোমরা ইহুদি বা নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য রেখ না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯৫)

একজন মুসলমান হয়ে ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রতি এতটা গাফেল থাকা সত্যি দুঃখজনক। অথচ পনের শতকের দিকে ্ দেশের বিভিন্ন স্থাপত্যের গায়ে হিজরি সনের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছিল। এক সময় মুসলমানদের দৈনন্দিন কাজে সন তারিখ গণনায় প্রথমেই হিজরি সন ব্যবহার করা হত তার পরে বাংলা ইংরেজিকে উল্লেখ করা হত। আর এখন হিজরি সনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। আমাদের মাঝে নেই তেমন কোনো উচ্ছ্বাস। অবশ্য এই উদাসীনতার পেছনে আমাদের দেশীয় মিডিয়ারও যথেষ্ট দায় আছে। নিউ ইয়ার এবং বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্র মিডিয়ায় নানান আয়োজন থাকলেও হিজরি নবর্ষ উপলক্ষে থাকে না চার লাইনের কোনো কলাম কিংবা দশ মিনিটের সুস্থ বিনোদন। পচান্নবই ভাগ মুসলমানের দেশে তাই হিজরি নববর্ষকে মলিন বসনেই দিন পার করতে হচ্ছে প্রতি বছর। অথচ একটা সময় ছিল; যখন এই বাংলার মানুষই দিন তারিখ গণনায় প্রথমেই গুরুত্ব দিতেন হিজরি সনকে। পরে উল্লেখ করতেন বাংলা ও ইংরেজি। সে সময়টা ছিল ১২০২ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার এর বঙ্গ জয়ের পর থেকে পরবর্তী ৬০০ বছর। তখনকার সময়ে প্রতিটি স্থাপনায়ই হিজরি সনের ব্যবহার হত। আর হবেই না কেন? এর সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে মুসলিম সভ্যতা, বিজয় ও ত্যাগ-তিতিক্ষার নানান নিদর্শন। জড়িয়ে আছে বিশ্ব মুসলিমের তাহজিব-তামাদ্দুন। সম্পৃক্ত ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান। এই যেমন- রোজা, হজ, ঈদ, শবে বরাত, শবে কদরসহ নানান আচার-অনুষ্ঠান। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(মুহাম্মাদ-সা) লোকেরা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন- তা হলো মানুষের এবং হজের জন্য সময় নির্ধারণকারী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৯)

এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা বান্দার সময়ের হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে চাঁদকে পঞ্জিাকাস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন। হিজরি সনের সাথে ইবাদতের সম্পৃক্তার গুরুত্ব যে কত অপরিসীম তা বুঝে আসে নবীজির এই হাদিসে, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে রোজা ভাঙো।’ (মুসলিম, হাদিস : ১/৩৪৭)

উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসের প্রেক্ষিতেই উলামায়ে কিরাম হিজরি সন গণনাকে ফরজে কিফায়া বলেছেন। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের ভাবা দরকার, আমাদের কি করার কথা আর আমরা কি করছি! কোন নববর্ষ উদযাপন করার কথা আর কোন নববর্ষ উদযাপন করছি। একজন বাঙালি হিসেবে যেমন বাংলা নববর্ষে আমরা উৎসবমুখর হই, তেমনি একজন মুসলমান হিসেবেও কি হিজরি নববর্ষে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা নয়? যতটা উৎসুক হয়ে বাংলা নববর্ষে বন্ধু-স্বজনদের মাঝে শুভেচ্ছা মেসেজ পাঠাই, তেমন উদ্দিপনায় কেন হিজরি নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করছি না? ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ চমৎকার একটি কথা বলেছিলেন, ‘আমরা বাঙালি যেমন সত্য, তার থেকে আরো সত্য আমরা মুসলমান।’

মনে রাখতে হবে, হিজরি বর্ষপঞ্জি, অন্য বর্ষপঞ্জির মতো নয়। হিজরি ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালেই আমাদের চোখের পাতায় ভেসে ওঠে সেই ত্যাগ-তিতিক্ষা আর ঘুরে দাড়ানোর ইতিহাস। প্রিয় মানুষ, আত্মীয়স্বজন, সম্পদ, বংশমর্যাদ ইত্যাদি ত্যাগ করে মুসলমানরা সেদিন হিজরত করেছিলেন এক আল্লাহর জন্য। আল্লাহর মনোনিত ধর্ম ইসলামের জন্য। পূর্ববর্তীদের এই ত্যাগে উজ্জিবীত হয়ে মুসলমান ইবাদতে গভীর মনোযোগি হোক, ভোগের জীবন ছেড়ে পরোপকারে নিয়োজিত হোক-এমনটাই চান মহান আল্লাহ। তাই আসুন! একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দেই হিজরি নববর্ষের ইতিহাস, প্রচলন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আনন্দ উচ্ছ্বাস,হিজরি,নববর্ষ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close