এম এ মাসুদ

  ০২ অক্টোবর, ২০২১

পরিবারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটুক প্রবীণদের জীবন 

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। আবার, যদি বলি সবচেয়ে অসহায় জীব কোনটি? সেটিও নিশ্চয় মানুষ। কারণ হিসেবে বলা যায়, অন্যান্য জীবের তুলনায় সদ্য ভূমিষ্ঠ মানব সন্তান খুবই অসহায়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরিচর্যা ছাড়া মানব শিশুর বেড়ে ওঠা অসম্ভব। আর সেই পরিচর্যার দায়িত্বটি নিঃস্বার্থভাবে পালন করেন আমাদের মা-বাবা। যাদের জীবন এক সময় ছিল তারুণ্যেভরা, প্রাণোচ্ছল, পরিবারের সদস্যদের সুখ, শান্তি ও মুখে হাসি ফুটানোর জন্য যাঁরা দিয়েছেন দিনরাত শ্রম, দিয়েছেন ছায়াদানকারী বৃক্ষরূপে আমাদের মাথার উপর ছায়া, সময়ের পরিক্রমায় আজ তাঁরাই এখন হয়েছেন প্রবীণ।

মা-বাবার নেই কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা, নেই কোনো দেশ। পৃথিবীর সব মা-বাবার ধর্ম ও পরিচয় শুধুই মা-বাবা। যাদের স্নেহ ভালবাসায় নেই কোন খাঁদ , নেই কৃত্রিমতা। প্রতিটি মা-বাবাই তাঁর সন্তানকে সেই জন্মলগ্ন থেকে মায়া, মমতা আর স্নেহের পরশ বুলিয়ে বড় করে তোলেন। চান বড় বা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে মানুষের মত মানুষ হোক, সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, হোক সম্মানিত আর চিনুক সবাই। সন্তানের সাফল্যের সাথে মা-বাবার সাফল্যও যেন একই সূত্রে গাঁথা। প্রিয় সন্তানের সাফল্যে নিজেকে ভাবেন সফল , হন খুশি আর পান মানসিক তৃপ্তি।

অর্থনীতিতে জনসংখ্যা বিষয়ে পড়তে গিয়ে জেনেছি, কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিতে শ্রমের যোগান হিসেবে বা বৃদ্ধ বয়সে নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে পুত্র সন্তান কামনা করতেন মা-বাবা। কিন্তু সময় বদলেছে, মানুষ এখন অনেকটাই সচেতন হয়েছে, এগিয়েছে দেশ, এগিয়েছে বিশ্ব। তাই এখন আর কৃষিতে অতিরিক্ত শ্রমের যোগান বা বৃদ্ধ বয়সে নিরাপত্তার গ্রান্টি হিসেবে পুত্র সন্তানের আশায় একের পর এক সন্তান জন্ম দেন না মা-বাবা। প্রত্যেক দম্পতি ই এখন যৌথভাবে তাদের পরিকল্পনাগুলোকে সুন্দর করে সাজান তাদের মনের মাধুরী দিয়ে। গড়ে তোলেন পরিকল্পিত পরিবার। আর এরই ধারাবাহিকতায় সন্তান গর্ভে আসার সাথে সাথে মনের রঙতুলি দিয়ে আঁকতে থাকেন তাদের রঙিন স্বপ্ন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তানকে পরম মায়া, মমতা, স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে তিল তিল করে বড় করে তোলেন।

নিজেরা আর্থিক দীনতায় ভুগলেও সেই দীনতা যেন সন্তানকে গ্রাস বা এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য চালান বিরতিহীন কর্ম প্রচেষ্টা। মা-বাবার এই যে নিরলস প্রচেষ্টা তা যে শুধু শুধু নিজেদের ভোগ-বিলাস বা সুখের জন্য নয়, তা বলাই বাহুল্য। তাদের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র সন্তানকে সুখী করার জন্য। যেখানে নেই কোনো চাওয়া, নেই কোনো পাওয়া, নেই কোনো হিংসা, নেই কোনো স্বার্থপরতা। সন্তানের পিছনে অকাতরে সব কিছু বিলিয়ে দেয়ার মধ্যেই যেন খুঁজে পান পরম আনন্দ। তাদের সুখের মাঝেই যেন পান প্রকৃত সুখ আর দুঃখে হন দুঃখী। ছায়াদানকারী বৃক্ষরূপে মাথার উপর ছায়া দেয়াই শুধু নয়, সন্তানের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবেও যাঁদের জুড়ি নেই, সেই মা-বাবাকে যখন ফেলে আসা হয় রেলস্টেশন বা রাস্তায় অথবা আশ্রয় হয় কোনো বৃদ্ধাশ্রম বা বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে, তখন তা ওই মা-বাবার জন্য শুধুই যে কষ্টের তা নয় বরং বেদনাদায়কও। ক্ষত-বিক্ষত হয় ওই মা-বাবার হৃদয়, ভেঙে পড়েন মানসিক দুশ্চিন্তায়। অসহায় বোধ করেন নিজেকে।

আবার, সমাজে যৌথ পরিবারের স্থলে গড়ে উঠছে একক পরিবার। সেক্ষেত্রে অনেক পরিবারেই দেখা যায় কয়েকটি সন্তান থাকলেও মা-বাবাকে খেতে হয় আলাদা। বাবা বেঁচে না থাকলে মায়ের অবস্থা হয় আরোও করুন। একদা যারা সুন্দর ও পরিপাটি ঘরে বাস করতেন তাদের বসবাসের বর্তমান ঘরটি যেন সন্তানদের ঘরের তুলনায় অনেকটাই অগোছালো ও জীর্ণশীর্ণ। স্ত্রী, সন্তানসহ সবার খাবার জুটলেও কেবল জুটেনা মা-বাবার। আবার সবার ভালো কাপড় জুটলেও জুটে না কেবল মা-বাবার ভাগ্যে। নিজেরা লেপ, তোষকের মধ্যে থাকলেও তার অভাব দেখা দেয় মা-বাবার ক্ষেত্রে । সন্তানদের জন্য হরেক রকম খাবার বা ফলমূল জুটলেও বাড়িতে বাসায় যে বৃদ্ধ মা-বাবা রয়েছেন যাঁরা এখন অবুঝ শিশুর মতো, তাদের জন্য নেই সেই হরেক রকম খাবার ও ফলমূল। সন্তানের অনুগ্রহের আশায় চেয়ে থাকেন অপলক দৃষ্টিতে। নেই কোনো অভিযোগও।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংকারসহ অনেক মা-বাবার স্থান হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে, ভাবা যায়! এই তো কিছুদিন আগে প্রতিদিনের সংবাদের শিরোনাম হয়েছে ‘এক বাবার করুণ দশা’। আবার ‘ সাত ছেলেই প্রতিষ্ঠিত, মোমেনা খাতুনের মানবেতর জীবনযাপন; বউয়ের জ্বালায় মাকে রেললাইনে ফেলে গেলেন ছেলে; খুলনার পাইকগাছায় বৃদ্ধ মা-বাবাকে রাস্তায় ফেলে গেলেন সন্তানেরা; শান্তিতে ঘুমাতে ফেলে গেল ছেলে, প্রচন্ড শীতে কাঁদছিলেন বাবা’ এ শিরোনামগুলো থেকে অনুমান করতে খুব একটা কষ্ট হয় না বৃদ্ধ মা-বাবাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পেতে। আর আমরা আমাদের চারপাশে তো তা দেখছি। মায়ের মৃত্যুতে দ্বিতীয় বিয়ে এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকা বাবার আর কোনো খোঁজ নেন না সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এমনও এক শিক্ষক সন্তান দেখেছি। অনাহারে, অর্ধাহারে কাটছে সেই অসুস্থ বাবার দিন।

অথচ বৃদ্ধ মা-বাবা ই একদিন তাদের সন্তানদের জন্য আরামের ঘুম হারাম করে দিন-রাত করেছেন পরিচর্যা, ভালো খাবার না খেয়ে হাসি মুখে তুলে দিয়েছেন তা সন্তানের মুখে। নিজেরা ভালো বস্ত্র না পরে সামর্থ অনুযায়ী দিয়েছেন সুন্দর সুন্দর পোশাক। বুক ভরা আশা নিয়ে পড়িয়েছেন ভালো ভালো স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। বানিয়েছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক আরো কত কি! আর নিঃস্বার্থভাবে সর্বদাই করেছেন স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা, চেয়েছেন তাদের মঙ্গল।

মা-বাবার বদৌলতে আমরা দেখেছি পৃথিবীর মুখ, দু’চোখ ভরে উপভোগ করছি প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য, যাঁদের আদর, যত্ন, স্নেহ, মমতায় বড় হয়েছি, উচ্চ শিক্ষিত হয়েছি , হয়েছি সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাই মা-বাবার প্রতি রয়েছে সন্তানের অনেক দায়িত্ব।

প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন মাকে নিয়ে লিখেছেন”আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা আমার মা। মায়ের কাছে আমি চিরঋণী। আমার জীবনের সমস্ত অর্জন তারই কাছ থেকে পাওয়া নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা আর শারীরিক শিক্ষার ফল।”

১৬ তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন ”যার মা আছে, সে কখনই গরীব নয়।”

কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘মা’ কবিতায় পড়েছি- মা কথাটি ছোট্ট অতি/কিন্তু জেনো ভাই/ইহার চেয়ে নামটি মধুর/তিন ভূবনে নাই।

মা-বাবার শারীরিক ও মানসিক সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে সন্তানদের। সন্তানের কোনো কথা যেন তাদের মানসিক যন্ত্রণার কারণ না হয়। ছোট বেলা থেকেই গড়ে উঠতে হবে মা-বাবার অনুগত হয়ে। তাদের লালিত স্বপ্নগুলো লেখাপড়ার মাধ্যমে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ৬০ বা ৬৫ বছর উর্ধ্বে বয়সী মা-বাবাকে তাঁদের কর্মজীবন থেকে অবসর নিতে হয়। প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্যে পৌঁছার কারণে তারা সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন যারা কীনা এক সময় সকল ব্যয়ভার মেটাতেন, বিপদে আপদে ছিলেন বটবৃক্ষের ন্যায় অটল। সেই মা-বাবার সুখের দিকটি দেখতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। খেয়াল রাখতে হবে তাঁদের স্বাস্থ্যের দিকে। মানতে হবে আদেশ-উপদেশ। কোনো অবাধ্যতা যেন তাঁদের মনোকষ্টের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত প্রত্যেক মা-বাবাই তাঁদের সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মাধ্যমেই সন্তান উচ্চপদে সমাসীন হন। আর ওই পদে গিয়ে যেন দরিদ্র ও অশিক্ষিত মা-বাবার কোনো প্রকার অসম্মান না হয়। আর মা-বাবার সেবা-যত্নের জন্য ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা তো রয়েছেই।

সন্তানরা চাকরি কিংবা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ায় এবং নাতি-নাতনিরা স্কুল, কলেজে যাওয়ায় একাকী হয়ে পড়েন প্রবীণরা। যাকে বলা যায় ঘরবন্দি জীবনযাপন। এই বয়সে এমনিতেই দেখা দেয় নানারকম শারীরিক জটিলতা। তাই বৃদ্ধ বয়সে একাকী থাকা তাদের জন্য কষ্টকর বৈকি! কারণ একাকীত্ব তাঁদের মনে জন্ম দেয় নানা হতাশারও। হয়ে পড়েন তাঁরা সেই সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুদের মতো অসহায়।

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, 'মায়ের একটি কষ্টের নিশ্বাস ৭টি দোযখের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মায়ের একটি মুখের হাসি ৮টি বেহেস্তের সমান।'

সুতরাং প্রবীণদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দময় পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা সন্তানেরই দায়িত্ব। প্রত্যেক মা-বাবাই চান বৃদ্ধ বয়সে তার সন্তানাদি, নাতি-নাতনিদের সাথে হেসে-খেলে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে। এটি খেয়াল রাখার দায়িত্ব পরিবারের সবার।

আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে আমরাও একদিন মা-বাবা হবো, হবো শ্বশুর-শ্বাশুড়ি। বয়সের ভারে হবো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। তাদের সাথে অন্যায় আচরণের কারণে তখন প্রকৃতি যেন আমাদের উপর প্রতিশোধ না নেয়! কোনো মা-বাবাকে যেন রেলস্টেশন বা রাস্তায় ফেলে না রাখে তার সন্তান, গোয়াল ঘর যেন না হয় তাঁদের ঘর, বৃদ্ধাশ্রম যেন না হয় তাদের ঠাঁই।

যাই হোক সকল বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য প্রতিটি পরিবার হোক নিরাপদ ও আনন্দের। ঘর হোক সাজানো, গোছানো এবং সুন্দর। সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে কাটুক বৃদ্ধ মা-বাবার জীবন সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রবীণ,মুক্তমত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close