মো. রাশেদ আহমেদ

  ০৩ মে, ২০২১

মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্যে ইরান

বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির ময়দানে সবচেয়ে আলোচিত নাম ‘ইরান’। পারস্য উপসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের দেশটি বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে বিভিন্ন কারণে আলোচনা-সমালোচনায় এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে ইরান নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পর নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ চার দশকের অধিক পথচলা। ইসলামিক রেভুলেশন পরবর্তী তেহরান বারবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমাদের বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজ গতি পথে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস তৈরি করেছে। যেখানে রাশিয়া এবং চীনের মতো পরাশক্তি দেশগুলোর অনবরত সমর্থন পেয়ে আসছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ চীনের সঙ্গে দীর্ঘ ২৫ বছরের সহযোগিতা চুক্তি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এ চুক্তি এখন পশ্চিমাদের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন যুগে যুগে মার্কিন প্রশাসনের মূল টার্গেটে পরিণত হচ্ছে ইরান। অথচ বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ে তেহরানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সময়ের পথপরিক্রমায় আজ যুক্তরাষ্ট্রের চোখে Rough State-এ পরিণত হয়েছে ইরান।

মূলত যুগ যুগ ধরে বিশ্বরাজনীতি পরিচালিত হয়ে আসছে মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে। কেউ বা আবার এটাকে অস্ত্রের রাজনীতি বা তেলের রাজনীতি বলে থাকেন। রাজনীতির চালিকাশক্তিই যখন অর্থনীতি তখন অস্ত্রই হোক আর তেলই হোক, মূল লক্ষ্য সম্পদ। বিশ্বরাজনীতিও চলছে সেই পথে। সম্পদ নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব অর্জনের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাজনীতি। বর্তমানে সিরিয়া, ইয়েমেনে চলছে গৃহযুদ্ধ। এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে আজও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অন্যদিকে লিবিয়ার অবস্থা ভঙ্গুর। অন্যদিকে অন্যান্য রাষ্ট্রে জঙ্গি তৎপরতা লেগেই আছে। কার্যত বর্তমান ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক অহিনকুল। যার পেছনে মার্কিনদের বড় স্বার্থ বিদ্যমান। তবে ট্রাম্প প্রশাসন শত্রুতার পর্যায়কে আকাশচুম্বী করেছিল। যদিও বর্তমান জো বাইডেন প্রশাসন এখন পর্যন্ত তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে যা করেছেন সেখানে খুব ভালো কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। প্রশ্ন হচ্ছে ইরানের প্রতি আমেরিকার কেন এই বৈরিতা!

পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো খুব ভালোভাবেই জানে যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে দমিয়ে রাখতে না পারলে উক্ত অঞ্চলে তেলের রাজনীতি বা অস্ত্র বিক্রির দেশ তৈরি করা যাবে না। সেই সঙ্গে আমেরিকার বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র সৌদি আরব ও মধ্যপাশ্চাত্যের ক্যানসার নামে পরিচিতি ইসরায়েল তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করতে পারবে না। সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের শিয়া, সুন্নি ধর্মীয় সমস্যা গোড়াপত্তনের। আর ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে ইরান-ইসরায়েল ঘোর শত্রু বিদ্যমান। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে খোঁড়া অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ১৪ জুলাই ২০১৫ ভিয়েনায় ইরান-ছয় জাতির পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে ট্রাম্প প্রশাসন; যা দেখে বিস্মিত হয় ইউরোপসহ গোটা বিশ্ব। কিন্তু তাতে আমেরিকার খুব বেশি যায়-আসে না। পরমাণু চুক্তি বাতিলের পর ইরানের ওপর আমেরিকা কঠোর অর্থনীতি অবরোধ আরোপ করে। উল্লেখ্য, ওই অবরোধ এখন পর্যন্ত বহাল রেখেছে জো বাইডেন প্রশাসন। বলতে সংকোচ নেই, এ অবরোধের মূল কারণ হচ্ছে ইরানকে অর্থনীতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলা। যাতে তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে না পারে। কারণ অর্থনীতি হচ্ছে একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি। অর্থনৈতিকভাবে ইরান ভেঙে পড়লে তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না, এটা পেন্টাগনের ধারণা। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। কঠোর নিষেধাজ্ঞার মাঝেও ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধি ২০ শতাংশ উন্নিত করেছে। কার্যত ২০০৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের অবরোধ ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও গত এক দশকে ইরানের সাফল্য ঈর্ষান্বিত। এখন ইরান সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের মুখোমুখি। কারণ হিসেবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণকে দায়ী করছে আন্তর্জাতিক মহল। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ। এমনকি ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়াও সতর্কতা অবলম্বন করেছে।

বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বরাজনীতিতে ইরানের প্রভাব যথেষ্ট বিস্তৃতি লাভ করেছে। ইতোমধ্যে ইরাক থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধে সৌদি জোটের প্রস্তাব। অপরদিকে, হিজবুল্লাহ, মিলিশিয়া গ্রুপের শক্তিবর্ধনে সক্ষম হয়েছে তেহরান; যা নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রাথমিক বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। রাশিয়া, চীনের মতো পরাশক্তি দেশের সঙ্গে আগে যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন উষ্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। যা ইরানের কূটনৈতিক সফলতা বহন করে। এ ছাড়া সিরিয়া যুদ্ধ নিরসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়া, তুরস্কের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে ইরান; যা তাদের সামর্থ্যরে প্রমাণ পাওয়া যায়। মানবসূচক উন্নয়নে তাদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। নারীদের অগ্রগতি, বিজ্ঞান প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নয়ন, সুস্থধারা সাংস্কৃতিক চর্চার, ক্রীড়া অঙ্গনে তাদের সাফল্য কম নয়। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পারস্য দেশটি। যা বিশ্বে বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে চতুর্থতম। এখানেই শেষ নয়, বিশ্বের তেল রপ্তানিকারক সংগঠন ওপেকের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। যে সংগঠনটি বিশ্বের তেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে ও অপরিশোধিত তেলের মূল্য নির্ধারণ করে। ইরান প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের দিক থেকে দ্বিতীয়। হরমুজ প্রণালির মতো গুরুত্বপূর্ণ জলপথ তাদের কৌশিলগত গুরুত্বকে আরো বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। এ জলপথ দিয়ে পৃথিবীর ৪০ শতাংশ খনিজ তেল পরিবহন করা হয়ে থাকে আর এশিয়ার পারস্য উপসাগরীয় এলাকা থেকে ৮০ শতাংশ খনিজ তেল আমদানি করা হয়। ইরানে বিগত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১২ শতাংশ। নিষেধাজ্ঞার কারণে ১০ লাখ ব্যারেল কম বিক্রি হয়েছে। বর্তমান ইরান সর্বকালের সেরা তেল রপ্তানি অবরোধের মুখোমুখি। যার কারণে তারা তেল রপ্তানি করতে বড় ধরনের ধাক্কার সম্মুখীন। যদিও চীনের সঙ্গে ইরানের সমঝোতা চুক্তি বর্তমান কঠিন পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া সম্ভব। ধারণা করা হচ্ছে, বেইজিং-তেহরান এ চুক্তির ফলে বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নতি হবে। কার্যত রাশিয়া, চীন এই অবরোধকে অবৈধ বলে প্রত্যাখ্যান করছে এবং ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি করতে দৃঢ়প্রত্যয়ী। কিন্তু আমেরিকার মিত্র রাষ্ট্রগুলো এই অবরোধ কার্যকর করেছে; যা ইরানের অর্থনীতিতে বড় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে তেহরানের আধিপত্য বেশি। মূলত ইরানের জেনারেল কাশেম সোলাইমানি হত্যাকান্ডের পর বেশ কোণঠাসা অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্ব। যার ফলে প্রতিনিয়ত মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাদের ওপর বাড়ছে আক্রমণ। অনেকটা বাধ্য হয়ে তারা ইরাক ছাড়তে শুরু করেছে। এদিকে চীন তাদের বিনিয়োগ দেখভাল করার জন্য ইরানে ৫ হাজার সৈন্য মোতায়েন করার সুযোগ পাবে। এরমধ্যে দিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার মধ্যপ্রাচ্যে সেনা সমাবেশের সুযোগ পাবে চীন। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বর্তমান ইরানের অর্থনীতি অনেকটা স্থবির। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে হু হু করে। সেই সঙ্গে বেকারত্বের সমস্যা তো আছেই। যে হারে বেকারত্ব বাড়ছে, সেই হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। যার ফলে তাদের সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। তবে এ কথাও ঠিক, ইরানের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, কাশেম সোলাইমানি ও পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যাকান্ড, পাশ্চাত্যের সঙ্গে চরম শত্রুতা ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাদের জাতীয় মনোবলকে ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়। বরং তাদের জাতীয় ঐক্যকে আরো বেশি দৃঢ় করেছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অপ্রতিরোধ্য ইরানিদের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ ও আমেরিকার শত হুমকি দিয়ে তাদের বিপ্লবী শক্তিকে দমিয়ে রাখা যাবে না। সময়ের পরিক্রমায় ফল হতে পারে উল্টো। সুতরাং ইরানের ওপর অবৈধ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও বহুল প্রতীক্ষিত পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনার টেবিল হতে পারে ইরান সংকট নিরসনে প্রধান উপায়। অন্যথায় ইরানকে চাপ দিয়ে নত স্বীকার করানো সম্ভব নয়। মনে রাখা দরকার যে, জাতি হিসেবে ইরানিরা অভেদ্য ও বিপ্লবী।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ইরান,মধ্যপ্রাচ্য,বিশ্বরাজনীতি,মুক্তমত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close