সম্পাদকীয়

  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

দিকনির্দেশক প্রাজ্ঞজনকে হারালাম আমরা

পৃথিবীতে কেউই চিরস্থায়ী নন। সবাইকেই যেতে হবে, যেতে হয়। তবে কিছু মৃত্যু আমাদের অনুভূতিতে পাখির পালকের মতো হালকা আর কিছু মৃত্যু পাহাড়ের চেয়েও ভারী। ভারী মৃত্যুগুলোই আমাদের হৃদয়কে করে ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত হয় আমাদের অস্তিত্ব। শোকাহত মানুষ কিছু সময়ের জন্য হলেও স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। বাকরুদ্ধ হয়ে কষ্টের সঙ্গে করে বোঝাপড়া। আমরা এখনো সেই বোঝাপড়ার মধ্যেই আছি। হারিয়েছি একসময়ের সাহসী পুরুষ ও এক দিকনির্দেশক প্রাজ্ঞজনকে। সৈয়দ আবুল মকসুদ আর নেই। দেশের প্রথিতযশা এই সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট গত মঙ্গলবার মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

গত মঙ্গলবার ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বিকালের দিকে প্রাজ্ঞজন সৈয়দ আবুল মকসুদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এ সময় তিনি বাসায় অবস্থান করছিলেন। একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ওই অবস্থায় তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাত সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি স্ত্রী, এক পুত্র, এক কন্যাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। জানিয়েছেন সমবেদনা।

দেশের প্রগতিশীল চিন্তা, গবেষণা ও আন্দোলনের অন্যতম এই অগ্রগামী ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর, মানিকগঞ্জে। পেশাগত জীবনে ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) কর্মরত একজন সাংবাদিক। এখানেও মর্যাদা রক্ষা করে শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। ২০০৪ সালের ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ‘হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত, ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’ শিরোনামে এই প্রাজ্ঞজন একটি কলাম লেখেন। এরপর তার কর্মস্থল বাসস কর্তৃপক্ষ ও তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায় থেকে তাকে কলাম না লেখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বাধীন সাংবাদিকতার গলা টিপে ধরার প্রশ্নে এটাই হচ্ছে এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা কূটকৗশল। সেই নেতিবাচক সংস্কৃতি বা কূটকৗশল তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। প্রতিবাদ জানাতে দেরি করেননি। ৩ মার্চ তিনি বাসস থেকে পদত্যাগ করে প্রশাসনের অনৈতিক নির্দেশনার সমুচিত জবাব দিলেন। মাঝখানে মাত্র দুটো দিন। চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র দেরি অথবা দ্বিধায় পড়তে হয়নি।

সাংবাদিকতা ও সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন একজন ধ্যানমগ্ন গবেষক। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি যেসব মতামতধর্মী প্রবন্ধ লিখতেন, তাতেও ছিল গবেষণা ও চিন্তার গভীর ছাপ। প্রথমা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত তার সর্বশেষ গ্রন্থ ‘নবাব সলিমুল্লাহ ও তার সময়’। এ ছাড়া প্রথমা থেকে প্রকাশিত তার অন্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে অরণ্য বেতার, স্মৃতিতে সৈয়দ ওলিউল্লাহ, সলিমুল্লাহ হল, স্যার ফিলিপ হার্টগ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য, কাগমারি সম্মেলন, রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘গোবিন্দচন্দ্র দাশের ঘর-গেরস্থালি, জার্মানির জার্নাল, ভাসানীর ভারত প্রবাস, মওলানা আবদুল হামিদ খান, গান্ধী ক্যাম্প এবং বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’ অন্যতম।

আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সৈয়দ আবুল মকসুদ আমাদের সমাজ জীবনের এতটা গভীরে প্রোত্থিত হয়ে আছেন; যাকে ইচ্ছা করলেও সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। নিজের যোগ্যতায় তার এ অর্জন। যোগ্যতা তাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে তিনি যে ভালোবাসা অর্জন করেছেন; প্রতিদানে আল্লাহও তাকে তার ভালোবাসায় সিক্ত করবেন। এটি আমাদের বিশ্বাস ও প্রত্যাশা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রাজ্ঞজন,সম্পাদকীয়,সৈয়দ আবুল মকসুদ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close