জাহাঙ্গীর আলম জাবির
লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক
হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ কাবা পরিদর্শন। সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের জন্য পৃথিবীর প্রথম উপাসনালয় কাবা শরিফ তাওয়াফ এবং মদিনা মনোয়ারা জিয়ারত আবশ্য কর্তব্য। হজের প্রথম তাৎপর্য হচ্ছে, এটি সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের এমন এক মহা সমাবেশ, যেখানে সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন বিভিন্ন বর্ণের, ভাষা এবং আকার-আকৃতির মানুষ একই ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে সমবেত হন। সবারই লক্ষ্য বিশ্বমানবের প্রথম উপাসনা কেন্দ্র কাবা শরিফ জিয়ারত, সবার মুখে একই ভাষার একটি মাত্র বাক্য ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’; যার বাংলা অর্থ ‘হাজির হয়েছি ওগো আল্লাহ হাজির হয়েছি। এসেছি, তোমার ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য এসেছি। আমার সবকিছু তোমার কাছে সমর্পণ করতে এসেছি।’
তাই বলতে হয়, হজের এ সফরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়, কোনো লক্ষ্য নয়, কোনো পার্থিব স্বার্থের আকর্ষণ নয়, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি, আল্লাহর নির্দেশে সমগ্র বিশ্বমানবকে আপন করে পাওয়ার আকুতিটুকুই একান্ত কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই হৃদয়ের গভীরে অঙ্কুরিত হয় বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের সেতুবন্ধন।
হজের এ মহাসমাবেশে সমগ্র বিশ্বমানব এমনই একটি কেন্দ্রবিন্দুতে এসে সমবেত হন, যা মানব জাতির প্রথম আবাসস্থল। ‘উম্মুল কোবা’ মক্কা নগরীতেই যে আদিমানব হজরত আদম (আ.) প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন এ তথ্য সন্দেহাতীত। সে আদি বসতির মধ্যেই এক আল্লাহর ইবাদত আরাধনার লক্ষ্যে স্থাপিত প্রথম গৃহ পবিত্র বাইতুল্লাহ। এ তথ্য ও পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত রয়েছে। বর্ণিত আছে, হজরত আদম (আ.) ‘উম্মুল কোবা’ পবিত্র মক্কায় স্থিত হওয়ার পর মোনাজাত বা প্রার্থনা করেছিলেন। ঊর্ধ্বজগতে ফেরেশতাগণের উপাসনাস্থল বাইতুল মামুরের অনুরূপ একখানা উপাসনালয় পাওয়ার জন্য। আল্লাহপাক সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেই ফেরেশতা জিব্রাঈলের মারফতে বাইতুল মামুরের সঠিক বরাবরই মাটির ওপর পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের স্থান নির্দেশ করেন।
এ ঘরের যে চৌহদ্দিটুকু ‘হেরেম’ বা পবিত্রতার সীমারেখায় চিহ্নিত, সেটুকুও ফেরেশতার মাধ্যমেই আল্লাহপাক দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ইতিহাসের সে প্রথম গৃহে মানবসন্তানের জন্য সৃষ্ট প্রথম ইবাদতগাহ বা উপাসনালয়ে আদি মানবের বাৎসরিক এ মহা সমাবেশে যে আবেগময় অনুভূতি সৃষ্টি করে সে অনুভূতি সমগ্র বিশ্ব মানব তথা আদি সন্তানের একই রক্তের উত্তরাধিকার এবং আত্মীয়তার অবিচ্ছেদ্য সেতুবন্ধনকেই নবায়িত করার অনুভূতি। পবিত্র কোরআনে এ-ও বর্ণিত আছে, আমাদের আদি পিতা-মাতা প্রথম যেখানে সিজদা করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা মহান প্রভুর উদ্দেশে। তার ইবাদতের লক্ষ্যেই গড়ে তোলা হয়েছিল সে ঘরটি। সুতরাং, সে ঘরের প্রতি একটা আবেগপূর্ণ আকর্ষণ প্রতি মানব সন্তানের মন-মস্তিষ্কে সুপ্ত হয়ে থাকাটা স্বাভাবিক।
হজের বার্ষিক সমাবেশ সে ঘরের জিয়ারত, সে ঘরের তাওয়াফ, স্মরণীয় সে ময়দানে গিয়ে অবস্থান যেখানে দীর্ঘ বিরহযাতনা ভোগ করার পর আমাদের প্রথম পিতা-মাতা এসে পুনর্মিলিত হয়েছিলেন, প্রাণভরে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। মুক্তি এবং শাস্তিধারা প্রাপ্তির আশ্বাসপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ণ প্রশান্তিতে রাত যাপন করেছিলেন। কয়েক দিনের হজের সফর প্রতিটি হজযাত্রীকে নিয়ে যায় মানুষের এ জন্ম প্রবাহ শুরুর সেই আদি দিনগুলোতে।
আজকের ভাষা, বর্ণ ও ভৌগোলিক সীমারেখা কণ্টকিত মানুষগুলো যখন কিছু দিনের জন্য সেই আদিমানবের সহজ-সরল পোশাক মাত্র দুই টুকরো কাপড় পরিধান করে হজের অনুষ্ঠানগুলো পালন করেন, তখন তার মধ্যে যে উপলব্দি জন্ম হয়, সেটা সব মানুষের প্রতি বন্ধুপ্রতিম মমত্ববোধ ছাড়া আর কী হতে পারে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে হজ অন্তত তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক দিক দিয়ে সামর্থ্যবান লোকজন হজ করতে যাবেন এটাই প্রত্যাশিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকেও কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কা শরিফে হজ ও মদিনা শরিফ জিয়ারত করতে যান। হজের প্রধান শিক্ষাই হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব মানবের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য এক ভ্রাতৃবোধ এবং সেতুবন্ধন তৈরি করা এবং ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ব্রতী হওয়া। হজরত নবী করীম (সা.) সর্বশেষ হজের ভাষণের মধ্যে এ শিক্ষাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে প্রদান করেছেন এবং উদাত্ত কণ্ঠে তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘লোক সকল, তোমাদের সকলের প্রভু এক, তোমাদের সবার আদি পিতাও এক ব্যক্তি। সুতরাং, কোনো আরব অনারবের ওপর, কোনো কৃষ্ণকায় শ্বেতাঙ্গের ওপর কিংবা কোনো কৃষ্ণকায়ের ওপর কোনো শ্বেতাঙ্গের জন্মগত কোনো প্রাধান্য নেই। সম্মান যোগ্য হবে সে ব্যক্তি যে একনিষ্ঠ খোদাভীরু। মনে রেখ, প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, আর বিশ্বের সব জনগোষ্ঠী মিলে এক মহাজাতি।
হজের মধ্যে উদ্দেশ্যের ঐক্য, পোশাকের ঐক্য, ভাষার ঐক্য এবং লক্ষ্যের ঐক্য বজায় রাখার তাগিদ এবং তৎসহ মূল লক্ষ্য ব্যাহত হওয়ার মতো সবকিছু থেকে দূরে থাকার তাগিদ ও কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। যেমন ‘হজ্বের সফরে অশোভন বা কেনো অন্যায় আচরণ আর ঝগড়া-বিবাদ যেন না হয়।’ হাদিস শরিফের ভাষায়, ‘তোমরা পরস্পর বিদ্ধেষ পোষণ কর না, একে অন্যের মর্যাদা হানির চেষ্টা কর না। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না। আল্লাহর সব অনুগত ব্যক্তি মিলে ভাই ভাই হয়ে বাস কর।’
হজের উল্লেখযোগ্য দুটি অনুষ্ঠান কোরবানি ও সাফা-মারওয়ার শায়িত হজরত ইসমাইল ও তার পুন্যবতী মা হাজেরার দুটো পূর্ণ স্মৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মহান পিতা-পুত্র হজরত ইব্রাহিম এবং ইসমাইলের অপূর্ব ত্যাগ-তিতিক্ষার পরীক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদেরকে বাইতুল্লাহ শরিফ পুনর্নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। কাবাঘরের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর হজরত ইব্রাহিমের প্রতি নির্দেশ হয়, সারা বিশ্বে হজের ঘোষণা প্রচার করার। তাকে আশ্বাস দেওয়া হল, ‘ঘোষণা প্রচার করা তোমার কাজ আর কিয়ামত পর্যন্ত ভক্তজনের হৃদয় কন্দরে সে ঘোষণা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। হযরত ইব্রাহিমের সে ঘোষণার যেসব বাক্য হাদিস শরিফ থেকে জানা যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে, কোনো বিশেষ দেশ, অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর প্রতি তার সে আহবান ছিল না, এ আহবান ছিল সমগ্র মানবজাতির জন্য।
মোট কথা, যেকোনো দিক থেকেই বিচার করা হোক না কেন, হজ এমন একটা আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান যার বিকল্প আর কোনো কিছু কল্পনাও করা যায় না। বিশ্বে এমন আর একটা অনুষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার মধ্যে বর্ণ, ভাষা ও জাতীয়তা নির্বিশেষে পৃথিবীর সব এলাকার সব ধরনের মানুষ এমন একমুখী এবং একাত্ম হওয়ার সুযোগ পায়।
মানুষের অন্তরে তার জন্মগত ঐক্যের অনুভূতি দৃঢ়তর করার উদ্দেশ্যেই পারস্পরিক কতগুলো প্রক্রিয়া অত্যাবশক করে দেওয়া হয়েছে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে সমবেত হওয়া, সপ্তাহে জুম্মার দিন এবং বছরে দুইবার বৃহত্তম সমাবেশ দুই ঈদের জামাতে গিয়ে হাজির হওয়া আবশ্যক। হজের সর্ববৃহৎ সমাবেশ সে ধরনের একটা বিশ্ব সম্মেলন। এ সম্মেলনের জামাতে দাঁড় করাতে। তাই বিশ্বজনীন এ অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষাই হচ্ছে হজের প্রধান শিক্ষা। আমরা আশা করি, এবারের হজ যেন বিশ্ব মুসলিমের জন্য সেতুবন্ধন তথা একতা, ঐক্য ও সহযোগিতামূলক হয়। আর এ শিক্ষায় যদি আমরা উজ্জীবিত হতে পারি তাহলেই সফল হব— আমরা এই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
পিডিএসও/তাজ