জুবায়ের চৌধুরী

  ২১ মে, ২০১৮

দুদকের ‘ঘুষের ফাঁদ’ আতঙ্কে দুর্নীতিবাজরা

*ঘুষের লাগাম টানতে চায় দুদক *আচমকা সরকারি অফিসে দুদকের টিম

দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের ‘ঘুষের ফাঁদ’ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে অসাধু কর্মকর্তাদের মধ্যে। ইতোপূর্বে ‘ঘুষের ফাঁদে’ সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ধরতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছিলেন দুদকের দুই কর্মকর্তা। এ ছাড়াও বেশকিছু ‘ঘুষের ফাঁদ’ পেতে দুর্নীতিবাজ ধরার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকেই আলোচনার সামনে চলে আসে দুদকের ‘ঘুষের ফাঁদ’।

দুর্নীতিবাজ ধরার এই পদ্ধতিকে আইনগতভাবে সম্পূর্ণ বৈধ ও যুক্তিসংগত বলে উল্লেখ করেন আইনজীবী ও দুদক কর্মকর্তারা। আইনজীবীদের মতে, দুদকের ‘ফাঁদ’ কার্যক্রমের ফলে দুর্নীতিতে ছেয়ে থাকা সরকারি অফিসগুলোয় ঘুষ-দুর্নীতির হার কিছুটা হলেও কমে আসবে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাবধান হয়ে যাবেন। এরই মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় তারা কারাগারে আছেন।

গতকাল রোববার দুপুরে ঘুষ আদায়ের অভিযোগে অডিট কার্যালয় ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) কার্যালয়ে ঝটিকা পরিদর্শন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক অভিযান সমন্বয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মহাপরিচালক (প্রশাসন) মুনীর চৌধুরী জানান, কিছু সরকারি অফিসে ঈদের আগে ঘুষের প্রবণতা বেড়ে যায়। এসব অফিসগুলোকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে ট্র্যাপ কেসের (ঘুষের ফাঁদ) মাধ্যমে ঘুষ আদান-প্রদান হাতেনাতে ধরা হবে।

দুদক সূত্র জানায়, বিভিন্ন সরকারি দফতরের সেবার মান উন্নয়ন এবং ঘুষ-দুর্নীতির প্রবণতা বন্ধে আলাদা দুটি এনফোর্সমেন্ট টিম গঠন করা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবারও একইভাবে বিএসটিআই ও অডিট কার্যালয়ে ঝটিকা পরিদর্শন করে। অডিট অফিসে ঘুষ ছাড়াই বিলগুলো যেন যথাসময়ে পাস হয়, তা নিশ্চিত করতে এ অভিযান চালানো হয়।

ফাঁদ পেতেই ‘ঘুষের লাগাম’ টানতে চায় দুদক : দুদকের অন্যতম এজেন্ডা ‘ফাঁদ মামলা’। এই ফাঁদ মামলা করেই ‘ঘুষের লাগাম’ টানতে চায় দুদক। এ জন্য দুদক চেয়ারম্যান সবার প্রতি ঘুষ প্রদানের আগেই ঘুষ গ্রহণকারীর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগের অনুরোধ জানিয়েছেন।

ফাঁদ মামলায় গতি ফিরেছে : ২০১৪ সালে ফাঁদ মামলা পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে সে কার্যক্রম দীর্ঘদিন কচ্ছপ গতিতে চলছিল। কমিশনের কঠোর নির্দেশে গত এক বছরে ফাঁদ মামলার কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুদক ও আদালত সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে মাত্র ৫টি ফাঁদ মামলা দায়ের হয়। আর ২০১৫ সালে ফাঁদ মামলা হয় তিনটি। এরপর ফাঁদ মামলার ওপর কমিশনের গুরুত্বারোপের ফলে ২০১৬ সালে ১৩টি ফাঁদ মামলা হয়। এরই ধারাবাহিকতা ২০১৭ সালে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ২৮টি ফাঁদ মামলা হয়। আর চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ছয়টি মামলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের ‘ফাঁদ’ কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৭ সালে। ওই বছরই এটি দুদকের ১৬ নম্বর বিধিতে সংযুক্ত করা হয়। এতে বলা হয়, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধের নিমিত্তে আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধে জড়িত কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে হাতেনাতে ধরার উদ্দেশে তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনারের অনুমোদনক্রমে তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফাঁদ মামলা (ট্র্যাপ কেস) প্রস্তুত করতে বা পরিচালনা করতে পারবেন।’ এ ছাড়া বলা হয়—‘ফাঁদ মামলা তদন্ত কার্যক্রম কেবল তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনার বা তদকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিশনের পরিচালক পদমর্যাদার নিচে নয় এমন একজন কর্মকর্তা দিয়ে সম্পন্ন করতে হবে।’

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘দুদক নিজে থেকে কাউকে লোভে ফেলে কিংবা ঘুষ দেওয়ার ফাঁদে ফেলে গ্রেফতার করে না কিংবা ফাঁদ তৈরি করে না। যদি কারো কাছে কেউ ঘুষ চায় আর ওই ব্যক্তি যদি দুদকের কাছে অভিযোগ করেন, তখন দুদক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দুদক স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু করে না।’

এ যাবৎ দুদকের ফাঁদে ধরা পড়লেন যারা : ফাঁদ পেতে দুর্নীতিবাজ ধরতে গিয়ে গত ১০ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নাজেহাল ও অবরুদ্ধ হয়েছিলেন দুদক কর্মকর্তারা। সিলেটের পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুদক কর্মকর্তারা ‘ফাঁদ’ পদ্ধতির মাধ্যমে বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়। এসব মামলায় তারা এখনো কারাগারেই আছেন।

এর আগে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি মাদারীপুর থেকে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মজুমদার মো. মাহফজুর রহমানকে ঘুষ নেওয়ার সময় হাতেনাতে গ্রেফতার করেন দুদক কর্মকর্তারা। এরপর ১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও থেকে গ্রেফতার করা হয় কেন্দ্রীয় খাদ্য গুদামের রেশনিং কর্মকর্তা বিউটি বেগমকে। ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (রাজস্ব সার্কেল-২) উপ-কর কর্মকর্তা আলী আকবরকে ঘুষসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করেন দুদক কর্মকর্তারা। ১৬ ফেব্রুয়ারি ঘুষের ২০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার করা হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উপ-কর কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জমাদ্দারকে। তার দেহ তল্লাশি করে আরো ১ লাখ ২ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।

গত বছরের ১৮ জুলাই ঘুষের পাঁচ লাখ টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার নৌপরিবহন অধিদফতরের (বিআইডব্লিউটিএ) প্রধান প্রকৌশলী ও শিপ সার্ভেয়ার এ কে এম ফখরুল ইসলাম। এরপর গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুদকের হটলাইন ১০৬-এ আসা অভিযোগ থেকে একদিনে ঢাকা, টাঙ্গাইল ও নরসিংদীতে ফাঁদ পেতে তিনজন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঘুষ নেওয়ার সময় হাতেনাতে গ্রেফতার করেছে দুদক। চাকরি দেওয়ার নামে এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার সময় রাজধানীর মিরপুর থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী সুলতান হোসেন তালুকদারকে গ্রেফতার করে দুদকের টিম। একইদিন টাঙ্গাইলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পেশকার জাকির হোসেনকে টাঙ্গাইল শহরের কোর্ট চত্বরের মজা রেস্টুরেন্ট থেকে ঘুষের ১৫ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়। এরপর নরসিংদী বিআরটিএ কার্যালয়ের সিল মেকানিক সুমন কুমার সাহাকে ঘুষের ১০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়।

এদিকে, চলতি বছরের ১১ এপ্রিল রংপুর বিভাগীয় শিক্ষা অফিসের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলামকে নিজ অফিস থেকে ৬০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়। এর আগে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলাম ও নাজমুল ইসলামকে হাতেনাতে ঘুষসহ গ্রেফতার করে দুদক। তাদের ধরতেও ঘুষের ফাঁদ পাতা হয়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঘুষের ফাঁদ,দুদক,দুর্নীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist