বাবুল আনোয়ার

  ১২ মে, ২০২৩

সমরেশ মজুমদার : কথাসাহিত্যের কালপুরুষ

গত ৮ মে প্রয়াত হয়েছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। তিনি পাঠকনন্দিত ছিলেন দুই বাংলায়। তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এ লেখা


সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত বই ‘সাতকাহন’ ও ‘কালবেলা’র ফ্ল্যাপে তার পরিচয়ে বলা হয়েছে, ‘তারপর নাটক লিখতে গিয়ে গল্প লেখা’। এ প্রসঙ্গে বলা বাহুল্য, এভাবেই কথাসাহিত্যে তার যাত্রা শুরু। গল্প থেকে মহাগল্প বা উপন্যাসে তার বিচরণ, বিস্তৃতি ও একজন সমরেশ মজুমদার হয়ে ওঠা। উপন্যাসে তার পূর্ণতা, প্রাপ্তির ষোলোকলা পূর্ণ। পাঠকনন্দিত দুই বাংলায়। অজস্র পাঠকের প্রিয় লেখক। পাঠকপ্রিয়তার কথা বললে অনেকে আবার নাক সিটকান। অনেকটা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘জনপ্রিয়তা লেখকের প্রকৃত পরিচয়ের মাপকাঠি নয়’। আমিও তাই মনে করি, তবে এর সঙ্গে ‘একমাত্র’ শব্দটি যোগ করে। এটাও মনে করি, ভালো লেখা ও লেখকও পাঠকপ্রিয় হতে পারেন। কেউ যদি যুগপৎ ভালো লেখেন ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তাতে দোষের কী? আমি বিষয়টিকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখি। থাক এসব কথা। সমরেশ মজুমদার নিয়ে আমরা অগ্রসর হই।

সমরেশ মজুমদারের লেখালেখির প্রধান ক্ষেত্র হলো কথাসাহিত্য। গল্প ও উপন্যাস। তবে নাটক ও ধারাবাহিক সিরিয়ালও রয়েছে তার। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৬৭-এ। ১৯৭৫ সালে প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি স্থিত হন তার সিদ্ধান্তে। দৌড়াদৌড়ির জায়গাটা এখান থেকে ফিক্সড হয়ে যায়। তার কথাসাহিত্যের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় চা-বাগানের শ্রমিক থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের নিত্যজীবন। তবে একই বৃত্তে তিনি থেমে থাকেননি। প্রতিটি উপন্যাসে নতুন বিষয়কে বেছে নেন। এই জীবনের স্বপ্ন, আশা, আলো অন্ধকার, টানাপড়েনের মানবিক অনুষঙ্গের চিত্রায়ণে তার সাবলীল উপস্থাপনা, গতিময়তা ও সরল বর্ণনাভঙ্গি পাঠকদের কাছে টানে। এর সঙ্গে যোগ হয় গভীর রাজনৈতিক বোধ। এ বোধের প্রকাশ ঘটে যথাক্রমে উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষ- এ তিন উপন্যাসে। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন-ঘোরে হাজার তরুণের ত্যাগ, আত্মাহুতি, সংগ্রামের নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এ উপন্যাসত্রয় রচিত। লেখক হিসেবে নতুন অবয়বে তিনি পরিচিত হন।

তার সৃষ্টি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্র, অবস্থান ও চেতনাগত পরিবর্তনের ধারাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরে। একটু আলোচনা করলে বিষয়টি সহজ হয়ে যেতে পারে। উত্তরাধিকার উপন্যাসের নায়ক অনিমেষের দেখা উত্তাল কলকাতা, শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক অবস্থা তাকে আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মানুসন্ধানের এক নতুন ভুবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এসব প্রশ্নের সমাধানে তার তরুণ জীবনে নতুন বোধের যোগ তাকে পরিণত করে এক ঋদ্ধ মানুষে। সে উপলব্ধি করে জীবন থেকে পালিয়ে জীবনের জয়গান সম্ভব নয়। মধ্যবিত্ত জীবনের নানা টানাপড়েনের এ কাহিনি লেখক হিসেবে তার জন্য সাফল্যের দিগন্ত উন্মোচিত করে। এ পথ ধরেই সৃষ্ট হয় কালবেলা ও কালপুরুষ। কালবেলায় এসে অনিমেষ নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করে। মনে হয় তার, রাজনীতিনিরপেক্ষ মাধবীলতা যে নিজেকে পুড়িয়ে তার জন্য সুন্দরের আগামী সৃষ্টি করতে চায়। অনিমেষের কাছে তখন সেই হয়ে দাঁড়ায় বিপ্লবের প্রতীক। বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা। কালবেলার জন্য ১৯৮৪ সালে তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। এর আগে ১৯৮২ সালে তিনি লাভ করেন আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার। সাতকাহন তার আরেক অমর সৃষ্টি। দীর্ঘ, সুবিন্যস্ত এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সাহসী, সংগ্রামী দীপাবলী—দীপার জীবনযুদ্ধের কাহিনি। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এগিয়ে চলা এক মেয়ের কাহিনি সাতকাহন, যা পাঠককে অতলান্তিক স্পর্শকাতরতায় বিমোহিত করে।

গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, ননফিকশন, কিশোর সাহিত্য মিলে তার সৃষ্টির সম্ভার বিশাল। অনেক লিখেছেন। বুনো হাসের পালক, গর্ভধারিণী, দৌড়, বন্দীনিবাস, উজান গঙ্গা, বর্ষাবসন্ত, ভালোবাসা, ভগবানের ভাইবোন, শরনাগত, আকাশ পাতাল, জীবন যৌবন, জালবন্দীর মতো গ্রন্থ। তার কিশোর সাহিত্য সমগ্র বাংলা কিশোর সাহিত্যের এক বিশেষ সংযোজন। বাঙালি সমাজের হাজার বছরের লালিত মূল্যবোধের সঙ্গে নতুন চিন্তা-চেতনার যোগ, এর সাংঘর্ষিক রূপ ও সমন্বয়ের বিষয়টিকে তিনি অনবদ্য কুশলতায় সাহিত্যে তুলে ধরতে সমর্থ হন। এভাবে তিনি জয় করেন লাখো পাঠকের হৃদয়। বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিকে অভিনন্দিত হন। হয়ে ওঠেন বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম কালপুরুষ।

পিডিএস/মীর

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কথাসাহিত্য,সমরেশ মজুমদার,উপন্যাস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close