সোহেল নওরোজ

  ১৯ মার্চ, ২০২১

স্বাধীনতার মাসে বইয়ের ডাক

অলংকরণ : হায়দার আহমেদ

করোনার থাবায় বদলে গেল কতকিছু! স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হঠাৎ করেই আটকে গেল শৃঙ্খলে। পাশে থাকার প্রত্যয় নিয়ে জাগ্রত মানুষগুলো দূরত্বকেই বেছে নিল নিরাপত্তার খাতিরে। স্পর্শে জড়িয়ে গেল অবিশ্বাস। স্থবিরতা সবখানে। বিধি-নিষেধের জালে আটকা স্বাভাবিক জীবন। ভয়-আতঙ্ক গিলে খাচ্ছে সোনালি সময়কে। জীবন বনাম মৃত্যুর লড়াইটা বড্ড একপেশে হয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র জীবাণুর কাছে এতটা অসহায় আর কবে হয়েছে মানুষ!

পারস্পরিক স্পর্শের এই ঘাটতি পুষিয়ে যাবে ভাষার মাসে, এমনটাই ছিল প্রত্যাশা। কারণ এটা যে প্রাণের মাস, বইমেলার মাস! অ আ ক খ ছুঁয়ে দেখার মাস। তাও হলো না। কোভিড দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে গেল গ্রন্থমেলার সামনে। অনিশ্চয়তার আবরণ ঘিরে ধরল রং-বেরঙের মলাটবন্দি বইগুলোকে। তবে কি অগণন হাতের ছোঁয়া লাগবে না বইয়ের মোড়কে? আড্ডা জমবে না সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, বাংলা একাডেমিতে? উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তা এমনভাবে বইমেলাকে ঘিরে ধরেনি আর কখনো। অবশেষে একটা ছাড় দিতেই হলো। ভাষার মাসের সঙ্গে বইমেলার দীর্ঘ ও দৃঢ় সম্পর্কটা আর অটুট-অচ্ছেদ্য রইল না। অক্ষরের মাস থেকে সরে স্বাধীনতার মাসে এসে পর্দা তুলতে হলো বইমেলার। তাতেও একটা তৃপ্তির সুবাতাস বইছে পাঠক, লেখক, প্রকাশক ও আয়োজকদের মনে। ওই যে ফেব্রুয়ারিতে না হোক, স্বাধীনতার মাসে হলেও বইমেলা তো হচ্ছে! মার্চও কী কম গৌরবের মাস! এই বইয়ের পাতায় ঢুঁ মারলেই আমাদের পরিচয়ের সঙ্গে মার্চের নিবিড় সম্পর্ক প্রতিভাত হয়। ৭, ২৬ সংখ্যাগুলো মার্চের মহিমাকে আকাশসমান করে তোলে। ফেব্রুয়ারির আপসহীন বীজটা দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পরে মার্চেই যে প্রথম চারাগাছের মতো দৃশ্যমান হয়েছিল!

বইমেলা না হলে কী এমন ক্ষতি হতো! আর্থিক লোকসানের বাইরে তেমন কোনো ক্ষতি চোখে নাও পড়তে পারে অনেকের। বিশেষ করে যখন ভাষার মাস পার হয়েই গেল, তখন এমন আয়োজনের যথার্থতা কোথায়! লেখক-প্রকাশক-পাঠকের সম্মিলন না হয় এ বছর না হলো! ভাবনাগুলো অমূলক নয়, তবে এমন ভাবনার মানুষেরা আসলে বুকের ভেতরের অধীরতা দেখতে পান না। বইমেলা কেবল বাইরের রংমাখা উচ্ছ্বাস নয়। রক্তের ভেতরের টান। সারা বছরের অপেক্ষা, প্রস্তুতি তো আছেই; তার সঙ্গে প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ, ক্যামেরার ক্লিকে বন্দি করে ফেলা প্রিয় মুহূর্ত এসব কি চাইলেই পাওয়া যায়? বইমেলা শুধু বইকেন্দ্রিক আয়োজন নয়, অস্তিত্ব ও চেতনার সঙ্গে মিশে থাকা বাঙালির এক মহা-উৎসবের উপলক্ষ। ১৯৮৩ সালে মনজুরে মওলা যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন, তখন তিনি বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্যোগ নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বছর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। তাতে পরিকল্পনা বিনষ্ট হয়নি। এর ঠিক পরের বছর, ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সেই থেকে বইমেলা নিয়ে উন্মাদনা ক্রমেই বেড়েছে। বাঙালি, ফেব্রুয়ারি আর বইমেলা এ যেন একই সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে পরিসর বিস্তৃত হয়েছে, প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও বাড়ছে বছরকে বছর। বাঙালির শুদ্ধ উৎসবগুলোর মধ্যে বইমেলার জৌলুশই যে বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।


কেমন হবে এবারের বইমেলা?—প্রশ্নটা যেন সবার মনেই উঁকি দিচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টির মুখে পড়ে আগেভাগে পাততাড়ি গুছিয়ে নিতে হবে না তো? আর্থিক লোকসানের মুখে পড়বে না তো প্রকাশকরা?


কেবল দেশের গতিতেই সীমাবদ্ধ নয় বইমেলার আবেদন। দেশের বাইরেও এমন অনেকে আছেন যারা মায়ের ভাষায় লেখালেখি করেন। তারা হয়তো বছরে একবারের জন্য দেশে আসেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বইমেলাকে পাখির চোখ করেই তারা বসে থাকেন। দিন গুনতে থাকেন বইয়ের সুবাস নেওয়ার জন্য। নতুন ধানের মতো নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মোহিত হয় তাদের মন। পূজা-পার্বণেও ঘরে বসে থাকা মানুষটি কোন অদৃশ্য টানে ছুটে আসে বইমেলায়! এ যেন ব্যাখ্যাতীত এক ব্যাপার! অনুভূতির কোন গহ্বরে পালতোলা নৌকার মতো নতুন বইয়ের পৃষ্ঠা ওড়ে তা বোঝা যায় কেবল বইমেলার সময়ই।

কেমন হবে এবারের বইমেলা?—প্রশ্নটা যেন সবার মনেই উঁকি দিচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টির মুখে পড়ে আগেভাগে পাততাড়ি গুছিয়ে নিতে হবে না তো? আর্থিক লোকসানের মুখে পড়বে না তো প্রকাশকরা? আসলে সব প্রশ্নের জবাব আগে থেকে দেওয়া একটু কঠিনই বটে। তবে শঙ্কা আছে। আর তা আছে বলেই এবারের বইমেলা কিছুটা হলেও অন্যবারের মতো হবে না। এটাকে নির্বিঘ্নভাবে শেষ অবধি টেনে নিয়ে যাওয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে আয়োজকরা কীভাবে উতরান তা দেখার বিষয়। ঝড়-বৃষ্টি থেকে স্টল রক্ষার জন্য বাড়তি সুরক্ষার বিকল্প নেই। হুটহাট বৃষ্টি থেকে আশ্রয় নিতে ক্রেতা-পাঠকদের যেন বিড়ম্বনা পেতে না হয়, সেটা নিয়েও নিশ্চয়ই ভেবেছে কর্তৃপক্ষ। বৃষ্টির কাছে ছাপা বইয়ের অসহায়ত্বের কথা কে না জানে! করোনাকালীন বইমেলা নিয়ে এমনিতেই নানা সংশয়, এর মধ্যে ঝড়-বৃষ্টির উপদ্রুব চিন্তার ভাঁজ যেন আর না বাড়ায় সে প্রত্যাশা থাকবে।

আবেগ আছে, ভাবনা আছে, শঙ্কা আছে; তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যা আছে তা হলো ভালোবাসা। বইয়ের প্রতি দুর্মর আকর্ষণ। তা আছে বলেই এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বইমেলা আয়োজনের সাহস করা যাচ্ছে। অনলাইনে বইমেলা করার পরিকল্পনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঐতিহ্যটাকে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে। এটাই যেন আরেকবার জানান দিচ্ছে নৈরাশ্যের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়াই আমাদের পরিণতি নয়, আমরা আলোর কাছে ভিড়তে পারি, ভালোর জন্য এক হতে পারি। এই মার্চেই বাঙালি দেখিয়েছিল কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাদের দমিয়ে রাখতে পারে না। ঠিকঠাক ডাক পেলে তারা ছুটে আসে প্রাণের স্পন্দনে। এবারও করোনা-প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ডাক দিয়েছে বইমেলা। এ কথা বলতে একেবারেই দুঃসাহস করতে হয় না, এবারও বইপ্রেমী পাঠক ছুটে আসবে পছন্দের বইয়ের ঘ্রাণ নিতে, বইয়ের অক্ষর স্পর্শ করতে।

পৃথিবী সুস্থ হলে আবার হয়তো ফেব্রুয়ারিতেই জমবে বইমেলা। ভাষার মাসে মুখর হবে বাংলা একাডেমি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এবারের এই বইমেলাটাই ব্যতিক্রম উদাহরণ হয়ে থাক, আমরা সেটাই চাই। দূরত্বের নিরাপত্তা নয়, স্পর্শের আনন্দে ভাসতে চাই। ধুলো উড়িয়ে হাঁটতে চাই বইমেলার চত্বরে। চায়ের কাপে আড্ডা জমাতে চাই। ফাল্গুনে ফুল পরিয়ে দিতে চাই প্রিয়তমার খোঁপায়। প্রিয় মানুষের হাতে তুলে দিতে চাই আঁতুড়ঘর থেকে সদ্য বেরোনো কোনো বই। ঐতিহ্য, মর্যাদা কিংবা ভালোবাসা যাই বলি না কেন, বইমেলাকে কোনো কিছুতেই ব্র্যাকেটবন্দি করা সম্ভব নয়। বাঙালির আবেগকে উপেক্ষা করার সাধ্য কার! বইমেলা যে আমাদের আবেগের জায়গা ভালোভাবেই দখল করে নিয়েছে তা বুঝতে পেছনে ফেরার দরকার নেই, এবারের বইমেলাই তো তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ!

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বই,বইমেলা,সাহিত্য,সোহেল নওরোজ,অমর একুশে গ্রন্থমেলা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close