প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
চার শিশু ও কৃষক খুনে ৬ জনের ফাঁসির আদেশ
রায়ে ক্ষুব্ধ-হতাশ চার মা
হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় চার শিশুকে হত্যার দায়ে তিনজনের ও ঝালকাঠিতে কৃষক মুনছুর আলী খানকে গলা কেটে হত্যার দায়ে দুই ভাইসহ তিনজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। গতকাল বুধবার সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মকবুল আহসান এবং ঝালকাঠি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মুহাম্মদ বজলুর রহমান এই আদেশ দেন। এদিকে, বাহুবলে চার শিশু হত্যার রায়ে প্রধান আসামি খালাস পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে নিহতের পরিবার। তিন আসামি খালাস নিহতের পরিবারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন চার শিশুর মা আমেনা খাতুন, ছুলেমা খাতুন, পারুল বেগম ও মিনারা খাতুন এবং একজনের দাদী মরম চান। একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত বছর ১২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রামের মনির মিয়া (৭), শুভ (৮), তাজেল (১০) ও ইসমাইল (১০)। এর পাঁচ দিন পর ইছাবিল থেকে বালিচাপা লাশ উদ্ধার হলে নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সবার বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয় আদালতে।
রায়ে প্রধান আসামি আবদুল আলী বাগাল, পলাতক আসামি বাবুল মিয়া ও বিল্লালকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও আসামি আরজু মিয়া, রুবেল মিয়া ও পালাতক উস্তার মিয়াকে ফাঁসির পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। মামলার অপর দুই আসামি জুয়েল মিয়া ও শাহেদ মিয়াকে সাত বছরের কারাদ-ের পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। বাচ্চু মিয়া নামের আরেক আসামি পলাতক থাকা অবস্থায় র্যাবের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন।
এদিকে, চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণায় বিচলিত হয়ে পড়েছে নিহত চার শিশুর পরিবার। শুধু তাই নয়, তিন আসামি খালাস নিহতের পরিবারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। বিরাজ করছে আতঙ্ক। অপরদিকে, পুলিশের পক্ষ থেকে ওই এলাকায় নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রধান আসামি আবদুল আলী বাগালসহ তিনজন খালাস পাওয়ায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি তারা। নিহত শিশুদের স্বজনরা বলেন, যে সবকিছুর পরিকল্পনা করলো, যার নির্দেশে ছেলেদের খুন করা হলো; সে কীভাবে খালাস পেয়ে যায়?
শিশু তাজেলের মা আমেনা খাতুন ও মনিরের মা ছুলেমা খাতুন বলেন, আব্দুল আলী বাগালের পরিকল্পনায়ই তাদের শিশুদের হত্যা করা হয়।
কাঁদতে কাঁদতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মা আমেনা খাতুন, ছুলেমা খাতুন, পারুল বেগম ও মিনারা খাতুন এবং একজনের দাদী মরম চান। একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।
রায় ঘোষণার পর মামলার বাদী নিহত শিশু মনিরের বাবা আবদাল মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ে আমি ও আমার পরিবার সন্তুষ্ট হতে পারছি না। প্রধান আসামি আবদুল আলী বাগালসহ পাঁচ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হয়নি। তাই তারা বাড়িতে আসার পরই আমাদের ওপর আক্রমণ শুরু করবে। এ জন্য আমি আমার পরিবার নিয়ে আতঙ্কে রয়েছি। নিহত শিশু ইসমাইলের মা মিনারা বেগম বলেন, আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। আমাদের শিশুদের যে নিষ্ঠুরভাবে মারা হয়েছে আমরা সব আসামির সেইভাবে ফাঁসি চাই। রায়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীও। মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আইনজীবীদের পরামর্শক্রমে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পিপি কিশোর কুমার কর বলেন, মামলার রায়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। এ রকম একটা নির্মম ঘটনায় আমরা আশা করেছিলাম সব আসামিকে মৃত্যুদ- দেওয়া হবে। এটি সিলেট বিভাগের সবচেয়ে চ্যাঞ্চল্যকর ঘটনা। পরিকল্পনা করে নিষ্পাপ চার শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা পরিকল্পনায় আসামিদের সবাই জড়িত ছিলেন। সবার শাস্তি হওয়া উচিত ছিল।
এদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. শফিউল আলমও এ রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এ রায় আইনের দৃষ্টিতে ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। আমরা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।
আসামিদের মধ্যে রুবেল মিয়া, আরজু মিয়া ও পলাতক উস্তার মিয়াকে মৃত্যুদ-সহ ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। আর শাহেদ ও রুবেলের ভাই জুয়েল মিয়াকে সাত বছরের কারাদ-সহ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন বিচারক। অনাদায়ে তাদের আরো ছয় মাস সাজা খাটতে হবে। হত্যাকা-ে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় সাজাপ্রাপ্ত জুয়েল-রুবেলের বাবা আবদুল আলী বাগাল, পলাতক আসামি বাবুল মিয়া ও বিল্লালকে আদালত খালাস দিয়েছেন। মামলাটি এ বছর ১৫ মার্চ হবিগঞ্জ থেকে সিলেট পাঠানো হয়। মামলায় মোট ৫২ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
ঝালকাঠি প্রতিনিধি জানান, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ২০০০ সালের ২২ অক্টোবর রাতে নলছিটি পৌর এলাকার নাঙ্গুলী গ্রামের কৃষক মুনছুর আলী খানের বাড়িতে হামলা চালায় আসামিরা। এক পর্যায় ঘরের ভেতর ঢুকে মুনছুর আলীকে গলা কেটে হত্যা করে তারা। এ সময় মুনছুরের ছেলে আবদুল মজিদ খান ও মেয়ে নিলুফা বেগমকেও কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা করা হয়। এ ঘটনায় পরের দিন নিহতের ছেলে আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে সাতজনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্ত করার দায়িত্ব দেন আদালত।
তদন্ত করে ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর দুই আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির পরিদর্শক আবুল খায়ের।
২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট আদালত পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বলে জানান এ আইনজীবী।
"