এইচ আর তুহিন, যশোর

  ১৫ আগস্ট, ২০২০

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে হতাহত

৩ কিশোরকে পিটিয়ে মারা হয়েছে : স্বজনদের দাবি

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন খুন এবং ১৫ জন আহত হওয়ার ঘটনাকে কর্মকর্তারা বন্দিদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ বলেছেন। তবে তা মানতে রাজি নন হতাহতের স্বজনরা। তাদের দাবি কেন্দ্রের কর্মকর্তারা এবং তাদের পোষ্য নিরাপত্তাকর্মী-বন্দিদের দিয়ে নির্মম নির্যাতন ও পিটিয়ে হত্যা করেছেন। স্বজনদের এ দাবির পক্ষে প্রামাণ মিলেছে যশোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের শরীরে জখমের ধরন থেকে।

এদিকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ঘটনার দিন মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছিলেন। পরে দুই-একজন দুই পক্ষের সংঘর্ষের কথা বললেও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেননি। তারা রহস্যময় আচরণ করেন।

তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে গত বৃহস্পতিবার তিন বন্দি খুন হয়। আহত হয় অন্তত ১৫ জন। নির্যাতনে খুন হওয়া তিন কিশোর হলো বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্বপাড়ার নান্নু প্রামাণিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), খুলনার দৌলতপুরের

রোজা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮) ও বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮)।

এ ঘটনার পর গতকাল শুক্রবার যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ ১০ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। কেন্দ্রটি বর্তমানে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ দিন কেন্দ্রের সামনে নিহত, আহত ও বন্দিদের স্বজনরা ভিড় করেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করে। এদিকে নৃশংসতার ঘটনায় শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। গঠিত হয়নি তদন্ত কমিটিও।

যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অমীয় দাস বলেন, বৃহস্পতিবার দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি লাশ আসে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে। সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিটে নাইম হাসান, সাড়ে ৭টায় পারভেজ হাসান এবং রাত ৮টায় আসে রাসেলের লাশ। এ চিকিৎসক বলেন, একজনের মাথায় ভারী কোনো বস্তু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। অন্যদের শরীরের আঘাতের বড় কোনো চিহ্ন শনাক্ত হয়নি। আর এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিহত ও আহতদের ধরে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সংঘর্ষ হলে আঘাতের চিহ্ন ভিন্ন হয়।

কর্তৃপক্ষ মারধরের ঘটনাটি বন্দিদের দুই পক্ষের সংঘর্ষ দাবি করলেও আহতরা জানায়, কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ও তাদের পোষ্যদের দিয়ে তাদের দফায় দফায় পিটিয়েছে। সে কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দি চুয়াডাঙ্গার পাভেল জানায়, গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) নূর ইসলাম তার চুল কেটে দিতে বলেন। সেদিন কেন্দ্রের প্রায় ২০০ জনের চুল কেটে দেওয়ায় হাত ব্যথা ছিল। সে কারণে তার চুল পরে কেটে দেওয়া হবে জানালে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গালাগাল করতে থাকেন। একপর্যায়ে কয়েক কিশোর তাকে মারধর করে।

এ বিষয়টি তিনি অফিসে জানান, কিশোররা মাদকসেবন করে তাকে মারধর করেছে। কিন্তু কিশোররা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে, তারা মাদকসেবন করেনি।

পাভেল আরো জানায়, ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে তাদের অফিসে ডাকা হয় এবং এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। ঘটনার আদ্যপান্ত জানানোর একপর্যায়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকসহ অন্যান্য স্যাররা মারধর করেন।

আহত আরেক কিশোর নোয়াখালীর বন্দি জাবেদ হোসেন জানায়, ‘স্যাররা ও অন্য বন্দি কিশোররা আমাদের লোহার পাইপ, বাটাম দিয়ে কুকুরের মতো মেরেছে। তারা জানালার গ্রিলের ভেতর আমাদের হাত ঢুকিয়ে তা বেঁধে মুখের ভেতর কাপড় দিয়ে এবং পা বেঁধে মারধর করেন। অচেতন হয়ে গেলে আমাদের কাউকে রুমর ভেতর আবার কাউকে বাইরে গাছতলায় ফেলে আসেন। জ্ঞান ফিরলে ফের একই কায়দায় মারধর করেছেন।’

যশোরের বসুন্দিয়া এলাকার ঈষান জানায়, নিহত রাসেল আর আমি একই রুমে থাকতাম। আগামী মাসেই তার জামিনে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। স্যারদের বেদম মারধর আর চিকিৎসা না পেয়ে সে মারা গেছে। সে অভিযোগ করে, প্রবেশন অফিসার মারধরের সময় বলেন, ‘তোদের বেশি বাড় বেড়েছে। জেল পলাতক হিসেবে তোদের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে।’

শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদের দাবি, সম্প্রতি কেন্দ্রে বন্দি কিশোরদের দুই গ্রুপের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরই জেরে বৃহস্পতিবার বিকালে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রড ও লাঠির আঘাতে মারাত্মক জখম হয় ১৪ কিশোর। প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন কেন্দ্রেই তাদের চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা চলে। তবে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় আশঙ্কাজনক একে একে আহতদের উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে নাইম, পারভেজ ও রাসেলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

তবে তিনি সংঘর্ষ দুপুরে হলেও আহতদের সন্ধ্যায় পাঠানোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো জবাব দেননি।

গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাসুদকে সংঘর্ষে ব্যবহৃত (তাদের বক্তব্য অনুযায়ী) লোহার রড-লাঠি কীভাবে বন্দিরা পেল, তার সদুত্তর দিতে পারেননি। নিয়মানুযায়ী বন্দিদের কাছে একটি ছড়ি কিংবা স্কেলও থাকার কথা না।

এ দিন খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি এ কে এম নাহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে মর্মান্তিক ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। আমরা যারা অপরাধ নিয়ে কাজ করি, তারা ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে বিষয়টি অবহিত হয়েছি। যে কারণে মূল ঘটনা জানা জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, যারা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তারাই এই ঘটনার মূল সাক্ষী। মৃত্যুপথযাত্রী কেউই মিথ্যা কথা বলে না। তাদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে তাদের বিষয় গুরুত্ব পাবে।

এদিকে শুক্রবার যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক-সার্কেল) গোলাম রব্বানী শেখ জানান, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত (বিকাল ৫টা) মামলা হয়নি। তবে সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মাসুদ, সহ-তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকুর রহমান, শারীরিক প্রশিক্ষক শাহনূর রহমানসহ কেন্দ্রে কর্মরত ১০ জনকে ভোরে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়। কেন্দ্রে তাদের রাখা ঝুঁকিপূর্ণ এবং মূল ঘটনার কারণ জানতে সমাজসেবা কর্মকর্তাদের পরামর্শে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা বর্তমানে যশোর পুলিশ লাইনসের ব্যারাকে রয়েছেন।

সমাজসেবা অধিদফতর যশোরের উপপরিচালক অসিত কুমার সাহা বলেন, ঘটনাটি আমরা মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়কে অবহিত করেছি। তিনি জানিয়েছেন, এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।

যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি গঠনের পর তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।

এদিকে তিন খুনের ঘটনায় স্বজনরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একইসঙ্গে তারা শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন। শুক্রবার সকালে কেন্দ্রের সামনে স্বজনদের অবস্থান ও কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।

নিহত কিশোর পারভেজের বাবা খুলনার মহেশ্বরপাশা এলাকার রোকা মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে পারভেজ বলেছিল, আমাকে যদি না নিয়ে যাও, তাহলে আমার লাশ নিয়ে যেতে হবে।’

নিহত অপর কিশোর রাসেলের ভাই বগুড়ার শেরপুর এলাকার ফরহাদ আলী বলেন, আমি এই ঘটনার বিচার দাবি করছি।

এদিকে শুক্রবার সকালে আরো এক আহত রুপককে যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ নিয়ে আহতাবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছে মোট ১৫ জন। অন্যরা হলো জাবেদ, আরমান, হৃদয়, লিমন, শাকিব, ঈশান পাভেল, শরিফুল, সাব্বির, হৃদয়, মাহিম, রাকিব, সাব্বির ও নাঈম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close