কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ০৬ জুলাই, ২০২০

করোনা পরীক্ষায় নাকাল চট্টগ্রাম

মৃত্যুর আগে অনেকে জেনে যেতে পারছেন না তার করোনা হয়েছিল কি না। আবার কেউ কেউ দীর্ঘ অপেক্ষার পর নমুনা দিতে পারলেও মিলছে না রিপোর্ট। উপসর্গ নিয়ে টেস্ট করতে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন আর কেউ রিপোর্টের জন্য হন্য হয়ে ঘুরছেন। আবার অনেকে রিপোর্ট পাওয়ার আগেই সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। সুস্থ হওয়ার পরও দেখা যায় রিপোর্ট তখনো তৈরি হয়নি। সৃষ্টি হয় রিপোর্ট-জট। দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে অনেকে হাল ছেড়ে দিচ্ছেন, তারা আর রিপোর্ট নিতে আসছেন না। এভাবে দিনের পর দিন চট্টগ্রামে চলছে করোনার নমুনা পরীক্ষা। চট্টগ্রামের করোনা পরীক্ষার হাল যে নাকাল, তা সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শনে প্রমাণ মেলে। এজন্য ল্যাবগুলোতে জনবল বাড়িয়ে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কমপক্ষে আরো ১০ থেকে ১৫টি পিসিআর মেশিন হলে জট কমতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র মতে, চট্টগ্রামে সরকারিভাবে চারটি এবং বেসরকারিভাবে দুটি কেন্দ্রে করোনার টেস্ট চলছে। রিপোর্ট পেতে ভোগান্তির শেষ নেই। বহু তদবির করে রিপোর্ট মেলে। বেশির ভাগের অবস্থা কাহিল। সপ্তাহ যায়, ১০ দিন এমনকি ১২ দিন পার হয়ে গেলেও রিপোর্ট পান না অনেকে। মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কাটে দিন। সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্রগুলোতে এখন প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি রিপোর্টের জট চলছে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, একই সঙ্গে বাড়ছে পরীক্ষা করানোর জন্য মানুষের সংখ্যা।

শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনভাইরাস (কোভিড-১৯) শনাক্তকরণ পরীক্ষা প্রায় ১ হাজার ৮০০-এর মতো জন্য নমুনা-জটে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। চট্টগ্রামে যত্রতত্র নমুনা পরীক্ষার বুথ স্থাপন করে নমুনা সংগ্রহের ফলেও পরিস্থিতি আরো জটিল বলে জানিয়েছেন ল্যাব সংশ্লিষ্টরা। নমুনা-জটের মধ্যে কেউ মারা যাচ্ছেন, কেউ আবার পজিটিভ থেকে নেগেটিভ, আবার কেউ নেগেটিভ থেকে পজিটিভ হচ্ছেন। এ মুহূর্তে ল্যাবের সক্ষমতা ও জনবল বাড়ানোর মত দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে, চন্দনাইন উপজেলার এক আইনজীবী আবুল কালাম করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন গত শুক্রবার। তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার তকি জানান, গত ২৪ জুন নমুনা দিলেও গতকাল রোববার পর্যন্ত রিপোর্ট পাননি। করোনার রিপোর্টের অভাবে বাবাকে ভালো করে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি।

বেসরকারি নিউজ চ্যানেলের এক সাংবাদিক জানান, গত ২৮ জুন নমুনা দিয়েছি, এখনো পজিটিভ-নেগেটিভ জানি না। বাসায় আইসোলেশনে থাকলেও সবার পক্ষে মেনে চলা সম্ভব না। ঘনবসতির এই নগরে এ রকম উদ্বেগ দিয়ে চলা মানে মৃত্যুযন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ল্যাবের প্রধান অধ্যাপক ডা. এহসানুল হক কাজল জানান, আমাদের হাসপাতলে ল্যাবে প্রায় ১ হাজার ৮০০ নমুনা পরীক্ষার অপেক্ষায় রয়েছেন। আমরা তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কয়েক দিন ধরে ল্যাবে নমুনা কম আসছে। কিন্তু আমরা প্রতিদিন প্রায় ৪০০ নমুনা পরীক্ষা করছি। এতে আগামী ছয় থেকে সাত দিনের মধ্যে আমাদের ল্যাবের নমুনা-জট কাটিয়ে উঠতে পারব।

বিআইটিআইডি ল্যাবের প্রধান অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমদ জানান, আমাদের ল্যাবে বর্তমানে কোনো নমুনা-জট নেই। আমাদের ল্যাবে প্রতিদিন যা নমুনা আসে, আমরা তাই পরীক্ষা করছি। অন্যদিকে, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবেও চট্টগ্রামের কিছু নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নমুনার চাপ বেড়ে গেছে। সেখানে কিছু নমুনা-জট রয়েছে।

বেসরকারি শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরির মহাব্যবস্থাপক পুলক পাড়লিয়াল জানান, ল্যাবে কোনো নমুনা-জট নেই। প্রতিদিনের নমুনা প্রতিদিন পরীক্ষা করে দিয়ে দিচ্ছি। তবে কয়েকটি নমুনা সংগ্রহের ত্রুটি থাকলে আবার নমুনা সংগ্রহ করে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করতে হয়। সে ক্ষেত্রে একটু সময় লাগছে। তিনি আরো জানান, ২০০ থেকে ৩০০ নমুনা সংগ্রহের জন্য আমরা ব্যবস্থা রেখেছি। কিন্তু সে তুলনায় নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে না। তবে নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে পরীক্ষা করা পর্যন্ত যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। যেসব লোকবল এসব কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের আলাদাভাবে রাখতে আমাদের আরো বেশি ব্যয় হচ্ছে।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি জানান, চট্টগ্রাম নগরীর নমুনাসমূহের মধ্যে জট রয়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলার সামান্য জট রয়েছে। সরকারি চট্টগ্রামে চারটি সরকারি ল্যাবের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নমুনা-জট রয়েছে। সেখান থেকে নমুনা সিভাসুতে পাঠানো হচ্ছে প্রতিদিন ২০০ করে। বিআইটিআইডির রিপোর্ট কয়েকদিন লাগে। চমেকে নমুনা-জট বেশি। আশা করছি চট্টগ্রামে চলতি মাসের শেষের দিকে নমুনা-জট কমবে। তবে এখন প্রায় ১৮০০-এর কাছাকাছি নমুনা-জটে পড়েছে। এদিকে, চট্টগ্রামে চমেকে একটি চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে নকল ফরম দিয়ে বাসায় বসে নমুনা দিয়ে এর রিপোর্টও পেয়ে যাচ্ছেনÑ এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) অধ্যক্ষ ডা. শামীম হাসান জানান, গোয়েন্দা সংস্থা এ ব্যাপারে খুবই তৎপর আছে। আমরা সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি। বাইরে কেউ যদি এ বিষয়ে প্রতারণা কিংবা ফাঁদ পেতে থাকে, তাহলে প্রশাসন তাদের কঠোরভাবে দমন করবে। জনস্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ডেপুটি গভর্নর আমিনুল হক বাবু জানান, এ মুহূর্তে চট্টগ্রামে ল্যাবগুলোতে জনবল বাড়িয়ে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি চট্টগ্রামের জন্য আরো কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি পিসিআর মেশিন দিতে হবে। তাহলে নমুনা-জট থাকবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close