পার্থ মুখোপাধ্যায়, কলকতা থেকে

  ১০ নভেম্বর, ২০১৯

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়

বাবরির স্থলে হবে মন্দির মসজিদ পেল ৫ একর জমি

অযোধ্যায় বিতর্কিত ২ দশমিক ৭৭ একর জমি রামলালার, জানিয়ে দিয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের নির্দেশ, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে অযোধ্যার মধ্যেই অন্যত্র বিকল্প ৫ একর জমি দিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। বিতর্কিত জমিতে মন্দির বানাতে তিন মাসের মধ্যে ট্রাস্ট বানাতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। একই সঙ্গে শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের আর্জি খারিজ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে নির্মোহী আখড়ার আর্জিও খারিজ বিচারপতিদের। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ছাড়াও গতকাল শনিবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি এস এ বোবদে, ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, অশোক ভূষণ এবং এস আবদুল নাজির। শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, ৩-৪ মাসের মধ্যে তৈরি করতে হবে ট্রাস্ট। তারাই বিতর্কিত জমিতে মন্দির নির্মাণের জন্য রূপরেখা তৈরি করবে। অযোধ্যাতেই মসজিদের জন্য মুসলিম সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে দেওয়া হবে ৫ একর বিকল্প জমি। এদিকে ভারতের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড জানিয়েছে, অযোধ্যার বিতর্কিত ভূমি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও তারা এই রায়ে সন্তুষ্ট নয়। আইনজীবীদের মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। আইনজীবী জাফরাইব জিলানি জানিয়েছেন, রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাবেন তারা। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের আইনজীবী জাফরাইব জিলানি বলেন, ‘আমরা রায়ে প্রতি শ্রদ্ধাশীল তবে আমরা সন্তুষ্ট নই। এই রায়ে স্ববিরোধিতা আছে। আমরা রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাব।

অবশেষে নিষ্পত্তি হলো ৭০ বছর ধরে চলে আসা আইনি লড়াইয়ের। অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে মন্দির তৈরি করার রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। রায় দিতে গিয়ে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) রিপোর্টকে গুরুত্ব দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। এএসআই-এর রিপোর্টে বলা হয় যে, খালি জমিতে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়নি। মসজিদের নিচে যে কাঠামোর সন্ধান পাওয়া গেছে এবং সেই কাঠামো ইসলামিক স্থাপত্য নয় বলে জানিয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। তবে মন্দির ভেঙেই যে মসজিদ তৈরি হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ এএসআই দিতে পারেনি। ৪০ দিনের ম্যারাথন শুনানির পর সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ। এই রায়ে অযোধ্যায় মন্দির বানানোর নির্দেশ দিলেও সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকেও জমি দেওয়া হয়েছে মসজিদ নির্মাণের জন্য। অযোধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাতে ওয়াকফ বোর্ড মসজিদ তৈরির জমি পায় তার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।

একই সঙ্গে শেষ হলো প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলতে থাকা বিতর্ক। মহাকাব্যে বর্ণিত রামজন্মভূমিতে মসজিদ তৈরি হওয়ার পরে প্রায় ৩৫০ বছর টানাপড়েন স্তিমিতই ছিল। মুঘল যুগ শেষ হয়ে ভারতে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠা পেতেই ফৈজাবাদের আদালতে আইনি লড়াই শুরু হয়ে যায়। তার প্রায় ১৩৪ বছর কেটে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে রায় দান সেই বিতর্কিত অযোধ্যা মামলার অবশেষে সমাপ্তি ঘটল। এই বছর ৬ অগস্ট থেকে টানা ৪০ দিন শুনানি হয়েছে অযোধ্যা মামলার। তার পরে ১৬ অক্টোবর রায় সংরক্ষিত রাখে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ। তারপর দেওয়া হলো এই রায়।

ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যাবে, ১৫২৮- এ মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মসজিদ তৈরি করান। প্রায় ৩০০ বছর পর ১৮৮৫ সালে ফৈজাবাদ জেলা আদালতে বাবরি মসজিদের বাইরে চাঁদোয়া টাঙানোর আবেদন জানান মহান্ত রঘুবর দাস। কিন্তু আদালতে সে আবেদন নাকচ হয়ে যায়। স্বাধীনতার ২ বছর পর ১৯৪৯ সালে বিতর্কিত কাঠামোর মূল গম্বুজের নিচে রাতে গোপনে রাখা হয় রামলালার মূর্তি। পরের বছর ১৯৫০ সালে রামলালার মূর্তিগুলোর পূজার অধিকারের আবেদন জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা আদালতে আবেদন করেন গোপাল শিমলা বিশারদ। ওই বছরই মূর্তি রেখে দেওয়ার এবং পূজা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মামলা করেন পরমহংস রামচন্দ্র দাস। ৯ বছর বাদে ওই জায়গার অধিকার চেয়ে মামলা করে নির্মোহী আখড়া। ২ বছর বাদে একই দাবি জানিয়ে মামলা করে সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড।

১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, স্থানীয় আদালত, সরকারকে নির্দেশ দেয়, হিন্দু তীর্থযাত্রীদের প্রবেশাধিকার দিতে। সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজীব গান্ধী। অযোধ্যা রামজন্মভূমির রামলালা বিরাজমনের কাছে বন্ধু তথা এলাহাবাদ হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি দেবকী নন্দন আগরওয়ালের মাধ্যমে মামলা করে। এর তিন বছর বাদে এলাহাবাদ হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, বিতর্কিত স্থানে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে। ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি গুজরাটের সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করেন। দুই বছর বাদে ১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বর, বি জে পি এবং সংঘ ঘনিষ্ঠ করসেবকরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেন। যার জেরে দেশজুড়ে দাঙ্গায় প্রচুর মানুষ মারা যান।

এর ক মাস বাদে ৩ এপ্রিল অযোধ্যার জমি অধিগ্রহণ করার জন্য বিতর্কিত এলাকার অধিগ্রহণ আইন পাস হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্টে এই আইনের বিভিন্ন বিষয়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রিট পিটিশন জমা পড়ে। সংবিধানের ১৩৯ এ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ওই রিট পিটিশন বদলি করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট যা এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন। তিন সপ্তাহ বাদে সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক ইসমাইল ফারুকি মামলায় রায়ে জানায়, মসজিদ ইসলামের অন্তর্গত ছিল না।

এর প্রায় ১০ বছর বাদে ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে বিতর্কিত স্থলের মালিকানা নিয়ে হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। এক বছর বাদে সুপ্রিম কোর্ট বলে, অধিগৃহীত জমিতে কোনো রকমের ধর্মীয় কার্যকলাপ চলবে না। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয় এলাহাবাদ হাইকোর্টে দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অন্তর্বর্তী আদেশ কার্যকর থাকবে।

এর প্রায় সাত বছর পর ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০ হাইকোর্ট রায় দেয় বিতর্কিত জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রামলালার মধ্যে সমবণ্টন করে দেওয়া হোক। এই রায়ে তিন বিচারপতি সহমত পোষণ করেননি। ২-১ ভিত্তিতে রায়দান হয়। এক বছর বাদে ৯ মে ২০১১, অযোধ্যা জমি বিতর্কে হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ বিতর্কিত স্থানে রাম মন্দির তৈরির অনুমতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। ২১ মার্চ ২০১৭ প্রধান বিচারপতি জেএস খেহর যুযুধান পক্ষগুলো আদালতের বাইরে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। ৫ মাসের মধ্যে ৭ আগস্ট এলাহাবাদ হাইকোর্টের ১৯৯৪ সালের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে করা আবেদনের শুনানির জন্য তিন বিচারপতির বেঞ্চ গঠন করে সুপ্রিম কোর্ট। পরের দিন, উত্তর প্রদেশের শিয়া সেন্ট্রাল বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে জানায়, বিতর্কিত স্থান থেকে কিছুটা দূরে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মসজিদ বানানো যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট, এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নির্দেশ দেয়, বিতর্কিত জমির ব্যাপারে সমর্থক মধ্যস্থতার জন্য দুজন অতিরিক্ত জেলা বিচারককে ১০ দিনের মধ্যে মনোনয়ন করতে হবে। সে সময় ,উত্তর প্রদেশের সিয়া সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড সুপ্রিম কোর্টকে জানায়, অযোধ্যায় মন্দির ও লক্ষেèৗয়ে মসজিদ বানানো যেতে পারে।

কিন্তু ১ ডিসেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্টে ২০১০ সালের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আবেদন করেন ৩২ জন নাগরিক অধিকার রক্ষা কর্মী। এর ৮ বছর বাদে সুপ্রিম কোর্টে সব দেওয়ানি মামলার আবেদনের শুনানি শুরু হয়। প্রথমেই সুব্রহ্মণ্যম স্বামীসহ সব অন্তর্বর্তী আবেদন, যারা এই মামলার পক্ষ হতে চেয়েছিল, নাকচ করে সুপ্রিম কোর্ট। ১৯৯৪ সালের রায়ে যে পর্যবেক্ষণ ছিল তা বৃহত্তর বেঞ্চে পুনর্বিবেচনা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান আইনজীবী রাজীব ধাওয়ান। সুপ্রিম কোর্ট সে সময় রায়দান স্থগিত রাখে এবং পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে মামলা নিয়ে যেতে অস্বীকার করে সুপ্রিম কোর্ট। জানানো হয়, মামলার শুনানি হবে নবগঠিত তিন বিচারপতির বেঞ্চে।

এরপর বিভিন্ন সময় মন্দির-মসজিদ বিতর্কে অনেক জল গড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ঘোষণা করে। শীর্ষে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন এস এ বোবদে, এনভি রামানা, ইউইউ ললিত এবং ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। কিন্তু বিচারপতি ইউইউ ললিত নিজেকে মামলা থেকে সরিয়ে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে বলেন, ২৯ জানুয়ারি নতুন বেঞ্চের সামনে মামলার শুনানি শুরু করতে। সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ সদস্যের নতুন সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করে। নতুন বেঞ্চের সদস্যরা হন বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি এস এ বোবদে, ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, অশোক ভূষণ এবং এস এ নাজির। তাঁরাই শেষ পর্যন্ত মামলার রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টে বিতর্কিত অংশ বাদ দিয়ে বাকি ৬৭ একর জমি তাদের আদত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন জানায়।

এদিকে ভারতের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড জানিয়েছে, অযোধ্যার বিতর্কিত ভূমি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও তারা এই রায়ে সন্তুষ্ট নয়। আইনজীবীদের মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। আইনজীবী জাফরাইব জিলানি জানিয়েছেন, রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাবেন তারা। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের আইনজীবী জাফরাইব জিলানি বলেন, আমরা রায়ে প্রতি শ্রদ্ধাশীল তবে আমরা সন্তুষ্ট নই। এই রায়ে স্ববিরোধিতা আছে। আমরা রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close