নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৮ আগস্ট, ২০১৯

ফিরতি যাত্রায় সড়ক প্রাণঘাতী

পবিত্র ঈদের ফিরতি যাত্রা প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। এবারও ঈদুল আজহার পর সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে বহু মানুষ। এবারের ঈদযাত্রাও ছিল দুর্ভোগে পরিপূর্ণ। ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা বিলম্বে বিশেষত উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের রেল ছেড়েছে। সড়কে যানজটের কমতি ছিল না, দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও ছিল উদ্বেগজনক পর্যায়ে। ঈদ-পরবর্তী সড়ক দুর্ঘটনা চোখে পড়ার মতো বাড়ছে। গেল বছরগুলোয় দুর্ঘটনার চিত্র দেখে আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপই চোখে পড়েনি।

এই প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান’। কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিতে মহাসড়কের ২৬০টির বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক আজও সরলীকরণ হয়নি, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়নি, ৩২ লাখ রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত গাড়ির বিপরীতে অবৈধ চালকের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। সড়ক-মহাসড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান রাজনৈতিক কারণে করা সম্ভব হয় না। বিচার হয় না দুর্ঘটনার জন্য দোষী চালকের। এ প্রেক্ষাপটে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে সত্যিই কঠিন, তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত তিন কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। ওভারস্পিড, ওভারটেকিং, যান্ত্রিক ও রাস্তার ত্রুটি। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস না পাওয়ার পেছনে রয়েছে নানা কারণ। চালকের লাইসেন্স প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে যানবাহনের ফিটনেস সনদ, গাড়ির অনুমোদন, সড়কের ত্রুটি, সঠিক তদারকির অভাবসহ সব ক্ষেত্রেই রয়েছে গলদ।

এআরআইয়ের গবেষণার তথ্য অনুসারে, গত ঈদুল ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ১৭২টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৫৪ জন। এর মধ্যে ঈদের আগের সাত দিনে ৫০টি দুর্ঘটনা ঘটে। আর ঈদের দিন থেকে পরের আট দিনে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১২২টি। ঈদের আগে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ৭২ জনের। পরের আট দিনে প্রাণ হারান দ্বিগুণ ১৪৪ জন। এবারের ঈদুল আজহার চিত্রও এমনই। ঈদের ফিরতি যাত্রা শুরু হওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার এক দিনেই সড়কে ২৫ জনের প্রাণ ঝরেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের আগে যানজটের কারণে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের গতি কম থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও বেশি থাকে। এ জন্য যাত্রী পরিবহন বেশি হলেও দুর্ঘটনার হার কম। কিন্তু ঈদের ফিরতি যাত্রায় সড়ক অনেকটাই ফাঁকা থাকার কারণে চালকেরা ইচ্ছামতো গাড়ির গতি তোলেন। দ্রুত যাত্রী নামিয়ে পুনরায় যাত্রী ধরার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। এছাড়া দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ চালকের ক্লান্তি। কারণ ঈদের আগে থেকে একটানা গাড়ি চালান চালকরা। ফলে তারা বিশ্রামের সুযোগ পান না। চালক-মালিক দুই পক্ষই বাড়তি আয়ের আশায় ঈদের আগে-পরে ১৫ দিন বিরামহীন বাস চালিয়ে থাকেন।

এআরআইয়ের তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে গত ঈদুল ফিতর পর্যন্ত সাতটি ঈদ উদ্?যাপিত হয়েছে। এসব ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৬১৩ জন। প্রতি ঈদের আগে-পরের সময়টাতে গড়ে প্রাণ হারান ২৩০ জন। অবশ্য যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে, ঈদের আগে-পরের ১৩ দিনে গড়ে ৩০০ মানুষের প্রাণহানি হয়।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, একই সড়কে ছোট, বড়, কম গতির ও বেশি গতির যানবাহন চলে। ফাঁকা সড়কে বেশি গতির যানবাহনগুলো কম গতির যানবাহনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় অনেক সময় দুর্ঘটনার জন্ম দেয়। মহাসড়কে দূরপাল্লার পথের বাস ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলে। গড়ে প্রতি এক মিনিট পরপর এসব বাস অন্য যানকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পেরিয়ে যাওয়ার (ওভারটেক) চেষ্টা করে। ফলে গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব বন্ধ না হলে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। মোটরযান আইন অনুসারে, একজন চালক একটানা পাঁচ ঘণ্টা যানবাহন চালাতে পারেন। এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে দিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা চালানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু চালকের সংকটের কারণে এটা মানা হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর চালকের বিশ্রাম ও কর্মঘণ্টা মানার বিষয়ে নির্দেশনা দেন। তবে এই নির্দেশনা পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা মানছেন না।

সড়ক দুর্ঘটনারোধে বিভিন্ন সময়ে নানামুখী পরিকল্পনা নেওয়া হলেও বাস্তবায়নের গতি খুবই কম। আইন প্রয়োগের দুর্বলতা সড়ক দুর্ঘটনা না কমার একটি বড় কারণ। সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা, চালক ও মালিকদের বেপরোয়া মনোভাব এ সেক্টরকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে। সরকার সড়ক নিরাপত্তায় জনবান্ধব যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে তারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সড়ক নিরাপত্তা আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ৯টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালনা, সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বৃদ্ধি, স্থানীয়ভাবে তৈরি দেশীয় ইঞ্জিনচালিত ক্ষুদ্র যানে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন, বিধি লঙ্ঘন করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং, জনবহুল এলাকাসহ দূরপাল্লার সড়কে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, দীর্ঘক্ষণ বিরামহীন গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও বেহাল সড়ক, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করতে হলে সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গাড়ির চালক, মালিকপক্ষসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের মানুষ সচেতন না হবে, ততক্ষণ সড়ক দুর্ঘটনা আইন করে রোধ করা যাবে না। সবার আগে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দুর্ঘটনার কারণে একদিকে চলে যায় মানুষের প্রাণ, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন গাড়ির মালিক। এটি বন্ধ করা জরুরি। সড়কের ত্রুটি দূর করার পাশাপাশি মানহীন যানবাহন মহাসড়কে চলাচল বন্ধ করতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close