গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৯

রমজানের আগেই সিন্ডিকেট সক্রিয়

মানুষের জন্য ভেজালমুক্ত খাবার নিশ্চিতে সময়ে সময়ে নানা উদ্যোগ নিয়ে থাকে সরকার। কিন্তু বিভিন্ন উৎসব ঘিরে ভেজালকারী চক্র সক্রিয় হয়ে সেসব উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়। ফলে খাদ্যে ভেজাল মেশানো বন্ধ করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে। অসাধু ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য থাকে, অপরিপক্ব ফল কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে উৎসবের আগেই বাজারজাত করা। রমজান আসন্ন। মুসলমানদের অত্যন্ত মূল্যবান এই সময়কে মোক্ষম হিসেবে বেছে এবারও বাজারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে চক্রটি। এতে বিভিন্ন সময়ে সরকারের নেওয়া উদ্যোগের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এদিকে, সিন্ডিকেট চক্রের এই সক্রিয়তায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়তে শুরু করেছে।

সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সারা দেশে ৭১টি বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত গঠন করা হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে নিরাপদ খাদ্য আইনে নিয়মিত মামলা করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের ৫০টি ল্যাবরেটরির তথ্যের সমন্বয়ে ডারেক্টরি করা হয়েছে। এছাড়া খাদ্য পরীক্ষার জন্য ১০টি ল্যাবরেটরি সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট ডেজিগনেট করা হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয়, বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা কমিটি কাজ করছে। এসব কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। কিন্তু এসবের মধ্যেও থেমে নেই ভেজালকারী চক্র।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে খাদ্যের মান নির্ণয়ের জন্য ল্যাবরেটরি রয়েছে। কিন্তু খাদ্যের নিরাপত্তা (বিভিন্ন রাসায়নিক ও অনুজৈবিক) পরীক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি নেই। সরকারের এই দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুবিধা নিয়ে থাকে। তাদের লক্ষ্য যেকোনো মূল্যে মুনাফা লাভ করা। বিগত বছরগুলোতে রমজানের বেশ আগেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ভাম্যমাণ আদালত অভিযানে নামেন। কিন্তু এ সময়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ উচ্চ আদালতের নির্দেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করায় এখন ভেজালবিরোধী অভিযান বন্ধ আছে। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্যের ভেজাল রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিকল্প নেই। উন্নত দেশগুলোতে খাদ্যের ভেজাল রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। তাদের মতে, জনস্বার্থে রমজানের আগেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ভেজালবিরোধী অভিযান পুনরায় শুরু করা উচিত। এর

মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার র‌্যাব-১০ এর একটি টিম ভেজালবিরোধী অভিযানে নেমেছে। পুরোনো ঢাকার বাদামতলী মেসার্স মোসুমী ট্রেডার্সে খেজুর গুদামে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর পাওয়া যায়।

মধু মাস হওয়ায় বাজারে এখন আম, লিচু, কাঁঠাল ও তরমুজসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল আসছে। এর মধ্যে ফলপ্রেমীদের প্রিয় ফল আম সময়ের আগেই বাজারে এসেছে। এতে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা এসব আমে ফরমালিন মেশানো হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযানে ১০টি টিম কাজ করছে। তারা খাবারে রঙ, খোলা খাবার ও মরা মুরগি ব্যবহার করা হচ্ছে কি না এ ব্যাপারে নজর রাখবেন। সন্দেহ হলে খাবার পরীক্ষা করেও দেখবেন। ভেজাল পাওয়া গেলে পরে ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হবে।

আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার বলেন, রোজায় আমরা বড় বাজারগুলো দ্রব্যমূল্যে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি মনিটর করব। প্রতি সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ দিন ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করব। তিনি আরো বলেন, দেশের মানুষের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর আস্থা তৈরি হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীদের শাস্তি দিতে এর বিকল্প নেই।

জানা গেছে, সরকার মানুষকে নিরাপদ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতে গত কয়েক বছর ধরে এ ব্যাপারে তৎপর রয়েছে। দেশে প্রথম ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে সরকার অভিযান পরিচালনা শুরু করে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে। বছরব্যাপী চলা ভ্রাম্যমাণ আদালদের ৫৮টি অভিযানে ২ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। আদালতের নির্দেশনায় বন্ধের আগ পর্যন্ত চলে এ অভিযান।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৫২৮টি অভিযানে ৮৫৮টি মামলার বিপরীতে কারাদন্ড হয় ১৭ জনের। এ সময়ে জরিমানা করা হয় ৮৬ লাখ ৮০ হাজার ৩০০ টাকা।

এভাবে সর্বশেষ ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের পরিচালিত ৪৫০৯টি অভিযোগের বিপরীতে ৭৫৬২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। যার মধ্যে সাজা হয়েছে ২১৪ জনের। এসব অভিযানে জরিমানা করা হয়েছে ৫ কোটি ৪৩ লাখ ১৩ হাজার ৩৪০ টাকা।

এদিকে, অভিযান চালানোর পাশাপাশি সরকার ভেজালমুক্ত খাবার নিশ্চিতে বেশকিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৫ বছর মেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। যার মধ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক ও অনুজৈবিক পরীক্ষার জন্য ফুড টেস্টিং রেফারেন্স ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করা, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ফল পাকানোর জন্য আর্টিফিসিয়াল র‌্যাপেনিং চেম্বার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিছন্নতা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে খাদ্য ও পানিবাহিত রোগের প্রকোপ কমাতে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা বিষয় অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এসব ইতিবাচক উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে অসাধু চক্রের যে খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে মুনাফা লাভের প্রচেষ্টা থাকে তা অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টরা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close