নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২১ নভেম্বর, ২০১৮

ইসিতে বিএনপির পৃথক চিঠি

৪৫ জেলার ‘উপদেষ্টা’ সচিবদের নিয়োগ বাতিলের দাবি

ইসি, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র সচিবসহ মাঠ প্রশাসন ও পুলিশে বদলি দাবি

জেলা পর্যায়ে সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক উন্নয়ন কাজ তদারকি করতে সরকারের সচিব পর্যায়ের ৪৫ জন কর্মকর্তাকে উপদেষ্টা (মেনটর) নিয়োগ আদেশ বাতিলের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। কর্মকর্তাদের মধ্যে ইসির সচিবসহ ৩৮ জন বর্তমান ও সাবেক সচিব এবং ৭ জন অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন। এ তালিকায় কয়েকজন সিনিয়র সচিবও আছেন।

গতকাল মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) দেয়া এক চিঠিতে এ দাবি জানিয়ে বলা হয়েছে, এ ধরনের দায়িত্ব প্রদান নির্বাচনকে চরমভাবে প্রভাবিত করবে এবং রিটার্নিং অফিসারদের ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি করবে। এ আদেশ বাতিল করা না হলে প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করতে আইন-আদালতের আশ্রয় নেয়া হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ইসি সচিব জানিয়েছেন, গত ১৩ নভেম্বর উপদেষ্টা নিয়োগ আদেশ স্থগিত করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

অপরদিকে আরেক চিঠিতে নির্বাচনে লেভেলপ্লেয়ং ফিল্ড তৈরি করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি), জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পুলিশ সদর দফতরের বদলির দাবি জানিয়েছে বিএনপি। পাশাপাশি প্রশাসন ও পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়েও বদলির কথাও বলা হয়েছে ওই চিঠিতে। ওই দাবি নাকচ করে ইসি জানিয়েছে, ঢালাও রদবদল প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে না। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এর আগে মঙ্গলবার দুপুরের দিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দলের পক্ষে পাঁচটি চিঠি ইসিতে গিয়ে দিয়ে আসেন। এর মধ্যে একটিতে ৪৫ জন উপদেষ্টা নিয়োগ আদেশ বাতিল ও আরেকটিতে প্রশাসনে বদলির দাবি জানানো হয়। এরপরই বিকালে কমিশনের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানান ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।

সচিব বলেন, ৪৫ জন মেনটর নিয়োগ সংক্রান্ত আদেশ ১৩ নভেম্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ স্থগিত করেছে। তিনি জানান, জেলা প্রশাসনে মেনটর নিয়োগ পূর্ব প্রচলিত। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এটা রুটিন কাজ। এ আদেশটি কমিশন অবহিত নয়। ৮ নভেম্বর আদেশটি করা হয়, ১৩ নভেম্বর স্থগিত করা হয়। ইসি সচিবের বিরুদ্ধে বিএনপির অভিযোগ নিয়ে হেলালুদ্দীন জানান, সচিব ইসির মুখপাত্র। ইসি সচিবের আলাদা সত্ত্বা নেই। কমিশনই সব সিদ্ধান্ত নেয়; সচিব তা বাস্তবায়ন করে ও সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে।

এর আগে বিএনপির দাবি প্রসঙ্গে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, তফসিল ঘোষণার দিন গত ৮ নভেম্বর ৪৫ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আমরা মনে করি, নির্বাচনের আগের-পরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের নগ্ন পদক্ষেপ এটি। এক প্রশ্নের জবাবে ইসির সচিবকে উদ্ধৃত করে আলাল বলেন, তাকে দেওয়ার দায়িত্ব কথা তিনি শুনেছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। তবে তিনি চিঠি পাননি। তিনি বলেন, সবার জন্য সমান সুযোগ এখন নেই। ইসি যদি তাদের অপসারণ করতে না পারে তাহলে কমিশন সবার দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হবে। সমান সুযোগ তৈরি করা কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির মহাসচিব ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত চিঠিতে ৪৫ জন কর্মকর্তার নামের তালিকা ইসিতে জমা দেয়া হয়েছে। ওই চিঠির সঙ্গে গত ৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা একটি আদেশের কপিও জমা দেয়া হয়। ওই আদেশে ৪৫ জন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার নাম, পদবি ও কোন জেলার পরামর্শক হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তা উল্লেখ রয়েছে।

৪৫ জন উপদেষ্টার নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়ে বিএনপির চিঠিতে বলা হয়েছে, তফসিল ঘোষণার দিন ৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৪৫ জন কর্মকর্তাকে ৪৫ জেলার পরামর্শক নিয়োগ দেয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ও প্রতিশ্রুত প্রকল্পগুলো নির্বাচনকালীন বাস্তবায়ন নির্বাচনে লেভেলপ্লেয়ং ফিল্ড ব্যাহত করবে, যা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অজানা নয়। এতে বলা হয়, উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সবাই রিটার্নিং অফিসারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাদের অধিকাংশকে নিজ জেলায় দায়িত্ব দেয়া হয়েছে; যা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের (জেলা প্রশাসক) নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনকে নিশ্চিতভাবে বিঘিœত ও বিব্রত করবে। চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, এ ধরনের দায়িত্ব প্রদান নির্বাচনকে চরমভাবে প্রভাবিত করবে এবং রিটার্নিং অফিসারদের ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি করবে।

চিঠিতে যে ৪৫ জন কর্মকর্তার নাম রয়েছে : চিঠিতে ৪৫ জন কর্মকর্তাকে ৪৫টি জেলার উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে মাদারীপুর, পরিবেশন ও বন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ইসতিয়াক আহমদকে মানিকগঞ্জ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সাবেক সচিব এম এ এন ছিদ্দিককে নরসিংদীর উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়েছে। এছাড়া সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে টাঙ্গাইল, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগমকে মুন্সীগঞ্জ, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগ সচিব সম্পদ বড়ুয়াকে কিশোরগঞ্জ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ সচিব কামাল উদ্দিন তালুকদারকে শরীয়তপুর, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ ইউসুফ হারুনকে গোপালগঞ্জের উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) মো. আবুল কালাম আজাদকে জামালপুর, পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য সুবীর কিশোর চৌধুরীকে ময়মনসিংহ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসানকে নেত্রকোনা ও নৌপরিবহন সচিব মো. আবদুস সামাদকে শেরপুরের উপদেষ্টা মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম খানকে যশোর, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. নমিতা হালদারকে বাগেরহাট, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শ্যামল কান্তি ঘোষকে ঝিনাইদহ, ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যানকে মো. আবদুল হান্নানকে খুলনা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মো. আকরাম-আল-হোসেনকে মাগুরার উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়।

এছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জিল্লার রহমানকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পানিসম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ারকে সিরাজগঞ্জ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে নওগাঁ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামালকে পাবনা, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সাইদুর রহমানকে নাটোর, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খন্দকার মো. ইফতেখার হায়দারকে রংপুর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. মাকসুদুল হাসান খানকে গাইবান্ধা, ভূমি সংস্কার বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহফুজুর রহমানকে কুড়িগ্রাম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক বনমালী ভৌমিককে পঞ্চগড়, জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. নুরুল ইসলামকে ঠাকুরগাঁও, প্রধান তথ্য কমিশনার মরতুজা আহমদকে সুনামগঞ্জ, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. আবদুল জলিলকে সিলেট এবং সাবেক নৌপরিবহন সচিব অশোক মাধব রায়কে হবিগঞ্জের উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়।

বাকিদের মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেককে পটুয়াখালী, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব নাজিমউদ্দীন চৌধুরীকে ভোলা, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. আবদুল হালিমকে বরিশাল, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইসমাইলকে ঝালকাঠি ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়াকে পিরোজপুরের দায়িত্ব দেয়া হয়।

চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরাকে, বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরীকে কক্সবাজার, বিপিএটিসির সাবেক রেক্টর আ ল ম আবদুর রহমানকে চট্টগ্রাম, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) এন এম জিয়াউল আলমকে কুমিল্লা, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীকে ফেনী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইনকে নোয়াখালী, নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে বান্দরবান, বিসিএস প্রশাসনক একাডেমির রেক্টর মো. মোশাররফ হোসেনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. মাকছুদুর রহমানকে চাঁদপুর জেলার উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়।

প্রশাসনে রদবদলের দাবি, নাকচ ইসির : বিএনপির চিঠিতে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বদলির কথা জানিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসি, জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পুলিশ সদর দফতরের মাঠ প্রশাসনে বদলি করতে হবে। বদলির ক্ষেত্রে ব্যাচের সিনিয়রিটি ও মেধাক্রম অনুসরণ করতে হবে। সব বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে প্রত্যাহার করতে হবে। সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বর্তমান কর্মস্থল জেলার বাইরে বদলি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত এবং মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী বা সমমানদের পিএস বা এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে তাদের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট পদে পদায়ন করা যাবে না। সব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। পদোন্নতিবঞ্চিত সব যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close