কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ০৯ জুলাই, ২০১৮

চরম ভোগান্তিতে রোগী ও স্বজনরা

চট্টগ্রামে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা বন্ধ

ম্যাক্স হাসপাতালকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা

চট্টগ্রামে বেসরকারি চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছেন ডাক্তাররা। গতকাল রোববার ম্যাক্স হাসপাতালে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলাকালে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান বেসরকারি হাসপাতাল সমিতির সভাপতি ডা. আবুল কাশেম। এ সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ম্যাক্স হাসপাতালেরই এমডি ডা. লেয়াকত আলী খান। এ ঘোষণার পর থেকে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী দেখা বন্ধ হয়ে যায়। এতে রোগীদের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। জানা গেছে, চিকিৎসাসেবায় এ অচলাবস্থা সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি ডাক্তারদের কালো হাত। তাদের লক্ষ্য সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। গতকাল বিকেল থেকে কোনো রোগী বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করা হচ্ছে না। ডাক্তারদের এই কর্মকান্ডে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। ভ্রাম্যমাণ আদালত চলাকালে জরিমানার ভয়ে কয়েকটি বড় হাসপাতাল আগেভাগে বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে এক নোটিসে জানানো হয়, সাংবাদিকদের হামলার প্রতিবাদে তারা এ চিকিৎসাসেবা বন্ধ রেখেছেন। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত নানা অনিয়ম পাওয়ায় ম্যাক্স হাসপাতালকে ১০ লাখ এবং সিএসসিআরকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করেন।

এদিকে ডাক্তারদের মধ্যে থাকা বিএনপি-জামায়াতের বড় অংশ চাইছে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশকে অশান্ত করার। তাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন সরকার সমর্থিত ডাক্তাররা। চট্টগ্রাম বিএমএতে বিএনপি-জামায়াতের ডাক্তারদের অবস্থান বেশ সক্রিয়। চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের মালিকও বিএনপি-জামায়াত। তাদের ইন্ধনে কতিপয় দোষী ডাক্তারকে বাঁচাতে পুরো বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা অচল করে দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে আলাপকালে চট্টগ্রামের আইনজীবী আবদুস সাত্তার বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোনো রোগীর চিকিৎসা ইচ্ছেকৃত বন্ধ রাখার কারণে রোগীর মৃত্যু হলে তা দ-বিধি ৩০২ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চিকিৎসার নামে গলা কাটা বাণিজ্যের শিকার হচ্ছে চট্টগ্রামবাসী। এ ছাড়া অদক্ষ-অনভিজ্ঞ ডাক্তার-নার্স দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে চট্টগ্রামের প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতাল। এতে ভুল চিকিৎসায় প্রাণ হারাচ্ছে অনেকেই। যার উদাহরণ চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় সাংবাদিক কন্যা রাইফা খানের মৃত্যু। রাইফার মৃত্যুর ঘটনায় সাংবাদিকদের আন্দোলন দমাতে স্বাস্থ্য খাতকে অস্থিতিশীল করার নীলনকশা এঁকেছে চট্টগ্রামের কয়েকজন চিকিৎসক নেতা। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত বুধবার মধ্যরাতে চিকিৎসকদের কয়েকজন চট্টগ্রামে একটি বৈঠক করেন। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ও স্থানীয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী এ বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন চিকিৎসক নেতার পাশাপাশি বিএনপি সমর্থিত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) এবং জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত এনডিএফ চিকিৎসক নেতারাও অংশ নেন। ওই বৈঠকের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, চিকিৎসকদের পাশাপাশি নার্স, দারোয়ান ও সুইপারদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামের চিকিৎসাকেন্দ্র ও রোগ নির্ণয়ের সব কেন্দ্র অচল করে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিএনপি সমর্থিত ড্যাব নেতা ডা. খুরশীদ জামিল। তার দুই মিনিট আটচল্লিশ সেকেন্ডের বক্তব্যটি হলোÑ প্রত্যেক সরকারি ডাক্তারের সঙ্গে বেসরকারি ডাক্তারের সম্পর্ক আছে। কেউ স্বীকার করেন, কেউ করেন না। সব জায়গায় স্ট্রাইক করতে হবে। এ বৈঠকের পর ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে বিএমএ নেতা ফয়সল ইকবাল চৌধুরী জানান, দল যার যার বিএমএ সবার। সুতরাং চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বিএমএর পতাকাতলে দলমতের ঊর্ধ্বে সব চিকিৎসক ঐক্যবদ্ধ চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশার মানসম্মান অক্ষুণœ রাখতে। এতে সরকার অস্থিতিশীলতার গন্ধ খুঁজলে কোনো লাভ হবে না।

অভিযোগ আছে, সরকারি চিকিৎসকরা হাসপাতালে সময় কম দিয়ে নিজের চেম্বারে বেশি সময় দেন। আবার অনেকের প্রাইভেট হাসপাতালও আছে। এসব চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসার জন্য তাদের সরকারি হাসপাতালে না পাঠিয়ে নিজের প্রাইভেট হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। অনেক চিকিৎসকই রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীদের নিজের পরিচিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করার নির্দেশ দেন, কমিশন প্রাপ্তির জন্য। সেখানে পরীক্ষা না করালে অনেক চিকিৎসক চিকিৎসা করতেও অসম্মতি জানান।

দৈনিক সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার রুবেল খানের আড়াই বছর বয়সী মেয়ে রাইফা গলায় ব্যথা নিয়ে গত ২৮ জুন বিকেলে ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ২৯ জুন রাতে তার মৃত্যু হয়। ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ করে বিক্ষোভ করেন সাংবাদিকরা।

গতকাল রোববার চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ত্রুটিপূর্ণ লাইসেন্সে অদক্ষ-অনভিজ্ঞ ডাক্তার-নার্স দ্বারা সেবা দেওয়ার দায়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে এসব অনিয়ম দূর করারও নির্দেশ দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযান শুরুর ঘণ্টাখানেক পর র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ম্যাক্স হাসপাতালে কিছু অসঙ্গতি পেয়েছি। রোগ নির্ণয়ে বিভিন্ন স্যাম্পল কালেকশন করে তারা চট্টগ্রাম ও দেশের বাইরের বিভিন্ন ল্যাবে পাঠিয়ে দেন। অনেকটা কমিশন এজেন্টের মতো তারা কাজ করেন। অথচ রোগীরা তাদের বিশ্বাস করেই এখানে মেডিকেল টেস্ট করান। দেশের বাইরে স্যাম্পল পাঠাতে সরকারি অনুমোদন লাগে। অথচ কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই তারা এসব নমুনা বিদেশে পাঠিয়েছে। সারোয়ার আলম বলেন, একজন নমুনা সংগ্রহ করছে, অন্যজন পরীক্ষা করছে আবার অ্যানালাইসিস করা হচ্ছে অন্য জায়গায়। এভাবে রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে ম্যাক্সের ল্যাবে। এগুলো আসলেই পরীক্ষা হয়েছে কি না, সেটাই তো নিশ্চিত না। বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে এইচএসসি পাস লোকজন চাকরি করছে। এখানে মিনিমাম স্নাতক ডিগ্রিধারী বা বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্নদের কাজ করার কথা। একটা হাসপাতাল চালাতে হলে অবশ্যই নমুনা পরীক্ষার নিজস্ব ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেটা তাদের নেই। অভিযানে ম্যাক্স হাসপাতালে ইতোমধ্যে এপিক হেলথকেয়ার, ল্যাবএইড, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডা. লাল প্যাথ ল্যাব, প্যাথ কেয়ার ল্যাব ও সিগমা ল্যাব লিমিটেডে করানো বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে। যাচাই-বাছাই শেষে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এদিকে ম্যাক্স হাসপাতালে এ অভিযানের জেরে চট্টগ্রামের সব বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সমিতি। গতকাল রোববার দুপুরে নগরের জিইসি মোড়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয়ে জরুরি সভা শেষে সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা. লিয়াকত আলী খান এ ঘোষণা দেন। ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খান বলেন, হাসপাতালগুলোতে ভর্তি থাকা রোগীরা এ ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। তাদের চিকিৎসা চলবে। এ ছাড়া বেসরকারি চিকিৎসকরা প্রয়োজনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের সেবা দিতে পারবেন। এদিকে হাসপাতাল মালিকদের এ ঘোষণার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখা। সেবা বন্ধ করার কারণে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা। চিকিৎ?সাসেবার জন্য সবাইকে ছুটতে হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist