ক্রীড়া প্রতিবেদক

  ১৯ মার্চ, ২০১৮

কান্নাভেজা আরেকটি রাত

৬, ৪, ৬, ০, ২, ৪। উনিশতম ওভারে পেসার রুবেল হোসেনের প্রতিটি বলের মানদন্ড এগুলো। নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে বাংলাদেশের স্বপ্নের সমাধি হয়ে গেছে ম্যাচ শেষের আগের ওভারটাতেই। ম্যাচটা যে সৌম্য সরকার শেষ বল পর্যন্ত আনতে পেরেছেন এটাই তো বেশি! শেষ ওভারে ১২, শেষ বলে ৫। অতিমানব হয়ে ওঠা দিনেশ কার্তিক ছক্কা হাঁকিয়ে রূপকথার এক জয় এনে দেন ভারতকে। ১২ বলে ৩৪ রানের যে প্রায় অসম্ভব সমীকরণ, সেটা কি দুর্দান্তভাবেই না মিলিয়ে ফেললেন কার্তিক, ভারত নিল ৩৫।

ঠিক যেন বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচের পুনরাবৃত্তি। ফলটাই যা ব্যতিক্রম। শুক্রবার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৪ বলে ১২ রানের জটিল সমীকরণের সমাধান দিয়েছেন এক বল হাতে রেখে। কিন্তু ভারত খেলল ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত। মাহমুদউল্লাহর ভূমিকায় কার্তিক। কাল রূপকথার এই জয়ে কুড়ি বছর আগের নিদাহাস ট্রফিটা অক্ষুণ্ন রেখে দিল ভারত।

৪ উইকেটের আরো একবার স্বপ্নভঙ্গ বাংলাদেশের। পঞ্চমবারের মতো তীরে এসে তরী ডুবল। পুরনো দুঃস্মৃতির ক্ষতে যে দাগ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বইয়ে দিয়েছে সেই ¯্রােতটা আরো বাড়িয়ে দিল কাল কলম্বোর হারটা। খুব কাছে এসেও আরো একবার শিরোপা হাতছোঁয়া দূরত্বে রেখে আসতে হলো টাইগারদের। এনিয়ে পাঁচটি ফাইনালে হারল বাংলাদেশ। কিন্তু কালকের হারটা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব যন্ত্রণাকে। আরো একটা কান্নাভেজা রাতের সাক্ষী হলো বাংলাদেশের ক্রিকেট।

ভারতের সঙ্গে লড়াই মানেই বাড়তি উন্মাদনা। কখনো কখনো লড়াইটা ছাপিয়ে পাদ প্রদীপে চলে আসে অন্যকিছুও। কিন্তু এবার ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব সীমানাকে। নিদাহাস ট্রফির অলিখিত সেমিফাইনাল এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে যে ফাইনালে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষ হিসেবে পেল দুই দলকে-শ্রীলঙ্কা এবং ভারতকে। কাল তো কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের গ্যালারি বাংলাদেশের দ্বাদশ প্রতিপক্ষও হয়ে উঠেছিল। বোঝাই দুষ্কর ম্যাচটা দ্বীপকুঞ্জের দেশে হচ্ছে নাকি ভারতের মাটিতেই। কলম্বোর ওই দর্শক চাপেই শেষ বাংলাদেশ। সৌম্যের শেষ বলে ৪ হলে ফাইনালটা হয়তো থ্রিলারের ওপর থ্রিলার উপহার দিতে পারত। ম্যাচটা যেতে পারত সুপার ওভারে। সেটার আর প্রয়োজন পড়েনি ম্যাচে কার্তিকের তৃতীয় ছক্কার কারণে। ছয় বছর আগে এশিয়া কাপের ফাইনালে হেরে দাঁড়িয়ে কাঁদা সাকিব কাল হতাশায় উপুর হয়ে মাথা গুজলেন প্রেমাদাসার ২২ গজের কেন্দ্রবিন্দুতে।

আসলে এই বাংলাদেশ ফাইনালের চাপ নিতে পারেনি। সম্ভবত ক্রিকেট বিশ্বের দ্বিতীয় দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে উঠেছে। চোক করছে কয়েকটা ফাইনালেই। আর তা না হলে ২ ওভারে ৩৩ রানের মতো হিমালয়তুল্য সম্বল আগলে রাখতে পারল না টাইগাররা! অথচ আগের ওভারে মনীশ পান্ডেকে (২৭ বলে ২৮) সাব্বির রহমানের শিকারে পরিণত করে জয়টাকে খুব কাছে নিয়ে এসেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান।

নিজের চতুর্থতম ওভারে মাত্র এক রান দিয়ে জয়টাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিলেন কাটার মাস্টার। পরের ওভারে ২২ রানের উদারতা দেখিয়ে ম্যাচ ও শিরোপা দুটোই আলোকবর্ষ দূরে নিয়ে গেলেন ডানহাতি পেসার। কার্তিকের হাতে রুবেল হলেন কচুকাটা। ৮ বলে ২৯ রানের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থ্রিলার ম্যাচটা ভারতের পক্ষে নির্ধারণ করে দেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের নতুন অধিনায়ক।

একটি আদর্শ ফাইনালের সম্ভাব্য প্রায়সব উপদানই ছিল। দুই ইনিংসেই ম্যাচটা দেখিয়ে বহু রং। বাঁক খেতে খেতে শেষ বলে এসে আশ্রয় নেয় ফলটা। বাংলাদেশের করা ১৬৬ রানের চ্যালেঞ্জিং পুঁজিটা ওই বলেই টপকে গেছে ভারত। ¯œায়ুঠাসা এই জয়ের ভিতটা গড়ে দিয়ে গেছেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। ফেরার আগে ৪২ বলে ৫৬ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। তার ইনিংসটার ওপর দাঁড়িয়ে সহজ জয়ই দেখছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা। কিন্তু ম্যাচের রংটা তখনও একবার বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশ রোহিতকে ফিরিয়ে।

ভারতের ইনিংসের শুরুতে ম্যাচটা প্রতিকূলে থাকলেও অনুকূলে আসতে সময় লাগল না। উদ্বোধনী জুটিতে ১৫ বলে ৩২ রান করে ফেলা ভারতকে একটু পরপরই চেপে ধরে বাংলাদেশ। স্কোর বোর্ডে আর কোনো রান যোগ না হতেই টাইগাররা সাজঘরে পাঠিয়ে দেয় শিখর ধাওয়ান ও সুরেশ রায়নাকে। সেখান থেকেই দলের হালটা ধরেছিলেন রোহিত। ১০ম ওভারেই তাই লক্ষ্যের অর্ধেক তুলে ফেলল ভারত। ২ উইকেটে ৮৩ রান, পরিষ্কার এগিয়ে ভারত। এমন অবস্থায় ওভারের তৃতীয় বলে রুবেলের বাউন্সার। হুক করতে গিয়ে সাব্বিরের হাতে ধরা পড়লেন রাহুল। জমে উঠল ম্যাচটা।

আসলে ম্যাচটা জমে উঠেছিল ১৪তম ওভারে। রোহিতকে মাহমুদউল্লাহর ক্যাচে পরিণত করে নাচলেন নিজ সৃষ্ট নাগিন নাচ। যা নিদাহাস ট্রফির সবচেয়ে আলোচিত দৃশ্য। আগের চার ম্যাচে উইকেটশূন্য থাকা নাজমুল ফাইনালের সেরা উইকেটটা পেয়েই কয়েক সেকেন্ডের জন্য হয়ে উঠেছিলন ‘মানব-কোবরা’। ভারত তখন জয় থেকে ৬৯ রান দূরে, হাতে ৪০ বল।

ফাইনালের জন্য সব জমিয়ে রেখেছিলেন সাব্বির রহমানও। একের এক ব্যর্থতার পর অবশেষে কাল দুঃসময়কে জবাব দিলেন তিনি। টস হেসে আগের ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশের ৩ উইকেটে ৩৩ রানের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে সাব্বির খেললেন ৫০ বলে ৭৭ রানের রাজসিক এক ইনিংসে। অথচ মাহমুদউল্লাহকে রান আউট করে খলচরিত্রও পেয়েছিলেন ক্ষণিকের জন্য। সেটা অবশ্য পড়ে আড়াল করে দিয়েছে চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে। ইনিংসে সাতটি চার ও চারটি ছক্কা হাঁকান সাব্বির। তার ব্যাটিং সন্ধ্যায় হতাশ করেছেন ফর্মে থাকা মুশফিকুর রহিম (৯), সাকিব আল হাসান (৭), সৌম্য সরকার (১) লিটন দাশ (১১)। ১৬ বলে ২১ রানে দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে ফিরে আসেন মাহমুদউল্লাহ। ৭ বলে মেহেদি হাসান মিরাজের ১৯ রানের অজেয় ইনিংসটার সুবাদে নির্ধারিত কুড়ি ওভারে ৮ উইকেটের ১৬৬ রান করেছেন সাকিবরা।

ক্যারিয়ার দ্বিতীয় সেরা ৭৭ রানের ইনিংসে ইনিংসটা সাব্বিরের হাতে তুলে দিতে পারত ম্যাচ সেরার পুরস্কারটা। কিন্তু রুবেল পাগলাটে ওভারটাই সব শেষ করে দিয়েছে। ম্যাচ সেরার পুরস্কারটা শেষ পর্যন্ত গিয়ে উঠল কার্তিকের বিশ্বস্ত হাতে। সেটাও শেষ ওভারের নাটকের পর। সৌম্যের প্রথম বলটা ওয়াইড। ৬ বলে ১১ রান। ডট, ১। ৪ বলে ১০ রান! আবারও ১, ৩ বলে ৯ রান। চতুর্থ বলে দুর্ভাগ্যক্রমে ৪, ২ বলে ৫ রান। পরের বল, উড়িয়ে মারলেন শংকর, মাহমুদউল্লাহ-মিরাজের যুগলবন্দিতে নাটকীয় ক্যাচে বাংলাদেশ যেন জয় দেখছিল। পরের বলে নির্মম বাস্তবতার শিকার বাংলাদেশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist