ফয়জুন্নেসা মণি
ভূমিকম্প
মানবিক বিপর্যয়ের নাম
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সুনাম আছে। মানুষের পাশে মানুষের এগিয়ে আসার বড় ধরনের উদাহরণও আছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলার অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু সুনামি ও ভূমিকম্পের মতো বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই। সাভারের ভবন ধসের ঘটনা প্রমাণ করেছে দ্রুততম সময়ে বিপর্যয় সামলানোর মতো প্রযুক্তি, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা আমাদের একেবারেই নেই। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ অঞ্চলের ৫০০ কিলোমিটার এলাকায় ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেরও আশঙ্কা আছে। ফলে ইন্দোনেশিয়ার মতো বাংলাদেশের উপকূলেও ভয়াবহ সুনামি দেখা দিলে পরিণতি কী হতে পারে ভাবা যায় না। মনে রাখা দরকার, কয়েক বছর আগে ভূমিকম্পে তুরস্কের একটি অঞ্চল ব্যাপক ধ্বংসলীলার শিকার হয়। দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশÑইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, থাইল্যান্ড, মাল™^ীপ উপকূলে যে ভূমিকম্প ও জলোচ্ছ্বাস হয় তাতে হাজার হাজার কোটি ডলারের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও দেড় লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ ভূমিকম্প ও জলোচ্ছ্বাস ছিল স্মরণকালের মারাত্মক বিপর্যয়। শক্তিশালী একটা ভূমিকম্প ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে যেকোনো সময়। এ বিষয়ে প্রায়ই সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু কতটুকু সতর্ক হচ্ছে বাংলাদেশ? প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত আমরা?
জাপানি সংস্থা সিডিএমপি দুই বছর গবেষণার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, মিয়ানমার-বাংলাদেশ বর্ডারে যেকোনো সময় ৮ দশমিক ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তি হবে। এই মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ১৮৯৭ সালে ওই বর্ডারে একবার ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই স্থানে যেকোনো সময় আবার ভূমিকম্প হবেই। মিয়ানমার-বাংলাদেশ বর্ডারের ওই স্থান থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ১৩০ কিমি। আর কক্সবাজার থেকে ওই স্থানের দূরত্ব ৩০ কিমি। মিয়ানমার-বাংলাদেশ বর্ডারে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রামে এর আঘাত হবে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার। এতে চট্টগ্রামের এক লাখ ৪২ হাজার বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা। হতাহত হতে পারে লাখো মানুষ।
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর থেকে বাঁচার উপায় নেই বললেই চলে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারও ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর নয়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার আমেরিকা ক্যাটরিনা ও উইলমার মোকাবিলা করতে পারেনি। কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের (সিডিএমসি) এক জরিপে বলা হয়েছে, সাড়ে ৭ বা ৮ মাত্রার ভূমিকম্পন হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটÑএই তিন বিভাগীয় শহরের ৪০ ভাগ ভবন ধসে পড়বে। জরিপে আরো বলা হয়েছে, মধুপুর ফল্টে দিনের বেলায় ভূমিকম্প হলে ঢাকায় প্রায় ৩১ হাজার মানুষ প্রাণ হারাবে। আহত হবে আরো ৫০ হাজার। একই মাত্রার ভূমিকম্পটি রাত ২টায় হলে প্রাণ হারাবে ১ লাখ ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ। আবার ঢাকার মধ্যে পুরান ঢাকার হতাহতের ঝুঁকি আরো বেশি। মানবসভ্যতার উন্নতির পথ ধরে খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও অবকাঠামো তৈরিতে সারাবিশে^ যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এতে যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে তেমনি ভূমিকম্প, সুনামি, হারিকেন ক্যাটরিনা, রিটা, উইলমা, সিডর, আইলা ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি বাড়ছে। বাংলাদেশ এখনো ভয়াল সিডর ও আইলার পরিণতি মোকাবিলা করছে। প্রযুক্তিনির্ভর জাপান, পারমাণবিক শক্তির অধিকারী ভারত এমনকি পাকিস্তানও পারেনি শতাব্দীর ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে। এই বাস্তবতা স্মরণ রাখতে হবে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ ১০টি শহরের মধ্যে আছে ঢাকার নাম। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই রাজধানী ঢাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। ঢাকার পরিণতি নিয়ে বহু লেখালেখিও হচ্ছে। কিছুদিন পর পরই ঢাকায় মৃদু ভূমকম্পন অনূভূত হয়। সিলেটের শ্রীমঙ্গল, আসাম সীমান্তের ডাউকি ফল্ট বা টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টের যেকোনো একটিতে রিখটার স্কেলে ৬ থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ৩০ শতাংশ ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আমরা জানি, ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম উপকূলে ভয়াবহ সুনামিতে নিহত হয় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ। ২০০৮ সালে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে স্কুল ও হাসপাতালসহ বহু সরকারি ভবন ধসে পড়ে। তখন শিশুসহ ৮৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। আবার হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সের ভূমিকম্প দেশটির জন্য চরম মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ আর পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে শোকে হতবিহ্বল হয়েছিলো পোর্ট অব প্রিন্সের জনগণ। দেশের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট আশ্রয় নিয়েছেন বন্ধুর বাসায়। যেখানে সেখানে গণকবর। স্কুল, হাসপাতাল, সরকারি অফিস, আবাসিক এলাকা, সুপার মার্কেট সবই বিধ্বস্ত। দেশটির পার্লামেন্ট, প্রেসিডেন্ট ভবন, অর্থ মন্ত্রণালয়, যোগাযোগ ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ অফিস ভেঙে পড়েছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা নগরীর অর্ধেকেরই বেশি ভবনের ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। পুরানো ঢাকায় প্রকৌশলীদের পরামর্শ, ডিজাইন বা সাহায্য ছাড়াই তৈরি হয়েছে ৬০ শতাংশ বাড়িঘর। ৬৫ শতাংশ বাড়িই ইট-সুরকির তৈরি। সমীক্ষায় প্রাপ্ত উপাত্ত দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় ৫.৫ রিখটার স্কেল মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এবং ৭ থেকে ৮ রিখটার স্কেল মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দালানকোঠা, ভবন বা ঘরবাড়ি ধসে পড়বে। ঢাকার প্রায় ৬৫ শতাংশ এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে নরম মাটিতে কিংবা জলাশয় ভরাট করা জায়গায় ৯ থেকে ১৪ তলা ভবন তৈরি। এতে ভূমিকম্পে পুরো বাড়িই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরীতেই প্রায় দুই কোটি লোকের বসবাস। সুতরাং ৬০ ভাগ ভবন ভেঙে পড়লে কী পরিমাণ লোকের প্রাণহানি ঘটতে পারে সহজেই অনুমেয়। ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৩ লাখ ২৬ হাজার বসতবাড়ির ওপর এক সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সাত থেকে সাড়ে সাত মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে রাজধানীর প্রায় ৭২ হাজার বসতবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। ৮৫ হাজার ভবন মাঝারি ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ভূমিকম্পের কারণে ৯০ হাজার মানুষ হতাহত হবে। ভূমিকম্পটি যদি দিনের বেলায় ঘটে, তবে হতাহতে সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৭০ হাজারের মতো।
ভূমিকম্প ঝুঁকি থেকে বাঁচতে বাড়িঘর নির্মাণের সময় প্রকৌশলীদের দিয়ে নকশা তৈরি, তত্ত্বাবধান ও জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ১. ভূমিকম্পের পর ভেঙে পড়া ভবনের নিচে আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার ও আগুন নেভানোর জন্য দমকলকে প্রস্তুত রাখতে হবে। ২. বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ইত্যাদি সার্ভিসকে নিয়ে সমন্বি^ত ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। ৩. ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় পাড়ায়, মহল্লায় স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া। সেখানে জনসাধারণের পাশাপাশি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, টেকনিশিয়ান, মিস্ত্রি ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করা। ৪. স্থানীয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, পূর্ত বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গ্যাস, টিএন্ডটি বোর্ড, অগ্নিনির্বাপণ বিভাগ ইত্যাদি সংস্থাগুলোর উদ্ধারকারী দল, প্রয়োজনীয় লোকবল, সরঞ্জামাদিসহ সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত এবং সমন্বিত থাকা। ৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস ও বাসাবাড়ির জনসাধারণকে ভূমিকম্প মোকাবিলায় সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক মহড়া অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। ৬. দক্ষ জনবল তৈরিতে প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞ টিমের সাহায্য নেওয়া উচিত। লেখক : কবি ও কলামিস্ট
"