বিশ্বজিত রায়

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

নিবন্ধ

রোহিঙ্গা সংকট ও আমাদের প্রত্যাশা

মনের সব বিষয় পুড়ে ছাই হয়েছে রোহিঙ্গাবিনাশী অগ্নিকুন্ডে। সেই দহন জ্বালায় সজীব মন হারিয়ে ফেলছে বেঁচে থাকার সুস্থ দিশা। আরাকানে সৃষ্ট ধৈর্যহীন কঠিন ক্রিয়াকর্ম মানবপ্রেমী যে কাউকে ব্যথিত করে তুলবে। রোহিঙ্গা বিতাড়নে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় শক্তি যে কায়দা অবলম্বন করছে তাতে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ প্রতিনিয়ত জ্বলেপুড়ে মরছে। অন্যদিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মানবতার ফেরিওয়ালা গোষ্ঠী। বিশ্বের ঘুমকাতুরে সম্প্রদায় হঠাৎ খোয়াবের সুরে বলে ওঠে, ‘রোহিঙ্গা বাঁচাও দিলাম আদেশ, সীমানা খোল বাংলাদেশ।’ এভাবে প্রতিবন্ধী মানুষের মতো বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে নিজেদের দায় সেরে নিচ্ছেন পৃথিবীর বড় বড় সংস্থাপ্রধান ও রাষ্ট্রনেতারা। মিয়ানমারের প্রতি সহানুভূতিশীল আন্তর্জাতিক মহল ন্যায্যতার বিপরীতে গিয়ে উল্টো বাংলাদেশকে চাপ প্রয়োগ করছে। রোহিঙ্গা ক্ষত সারাতে বার্মিজ দেহে মলম না লাগিয়ে সেই প্রতিষেধক বাংলাদেশের গায়ে সজোরে ঘষে চলেছে প্রভাবশালী দুনিয়া। যারা অপরাধ করছে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নিয়ে, বরং প্রতিবার বাংলাদেশের দিকে তেড়ে আসার চেষ্টা চলছে। আবার লোক দেখানো প্রশংসায় ভাসিয়ে বাংলাদেশকে বাগে আনার ধূর্ত প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে কি না সেটাও ভেবে দেখতে হবে। স্বার্থবাদী সম্প্রদায়ের এহেন আচরণ মিয়ানমারকে মৌন সমর্থন ছাড়াও রোহিঙ্গা বধের মন্ত্রও শিখিয়ে দিচ্ছে কি না- তাও ভেবে দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মাথা ঘামাতে গিয়ে সামনে চলে আসছে সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় উগ্রবাদের বিষয়টি। বিশেষ করে এ দুটি কারণই বিশ্বে জন্ম দিয়ে যাচ্ছে শিষ্টাচারবহির্ভূত নানা কর্মকান্ড। এক দল যদি থাকছে এর পক্ষে, অন্যদল করছে তার বিরুদ্ধাচরণ। এতে করে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে মানবতা। মানবিকতা ও অমানবিকতার যুগলবন্দিতে চলছে পৃথিবী। বিশেষ করে অমানবিকতার ভয়ঙ্কর ছোবলে মারাত্মক আহত এ মনুধরা। নাফ নদের এক পারে চলছে মানবতা ধ্বংসের প্রক্রিয়া আর অপর পারে চলছে মানবতা রক্ষার জোর তৎপরতা। একদিকে শান্তির পতাকা হাতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি রয়েছেন রোহিঙ্গা নিধনের মহোৎসবে মত্ত, অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার অসহায়ত্ব দেখতে এবং করুণ কান্না শুনতে প্রধানমন্ত্রী ছুটে যান কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রিত এলাকায়।

গত ১২ সেপ্টেম্বর সকালে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছে সেখান থেকে উখিয়ার কুতুপালংয়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনে স্থানীয় একটি কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তিনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমরা সকল দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই, নির্যাতন বন্ধ করুন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিন।’ আর রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘যতদিন তারা নিজ দেশে ফিরতে পারবেন না ততদিন বাংলাদেশ তাদের পাশে থাকবে।’

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরাকান রাজ্যে শান্তির কপোতী অং সান সু চির অশান্তির অনলে অঙ্গার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক পরিণতি দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরে তাদের সঙ্গে কথা বলেন, শোনেন বর্বর অত্যাচারের নির্মম কাহিনি, জড়িয়ে ধরে রোহিঙ্গা অশ্রুফোঁটা নিজের গায়ে মেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। একেক রোহিঙ্গা নর-নারী তাকে যখন তাদের ওপর ঘটে যাওয়া মিয়ানমার বাহিনীর হিং¯্র ছোবলের বর্ণনা শোনাচ্ছিলেন তখন তিনি অশ্রুসংবরণ করতে পারেননি। এমনকি তার সফরসঙ্গীদের অনেকে চোখ মুছতে থাকলেন। অশ্রুসজল পরিবেশ। নির্যাতনের বর্ণনা এত অমানবিক যে, তা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সহ্য করার মতো নয়। এ যেন একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নিধনের ঘটনার আরেক রূপ।

অত্যাচার নির্যাতনের যন্ত্রণা কতটা ভয়ানক বাঙালি তা ভালো জানে। কারণ একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার এবং এ দেশীয় বাঙালি অবিবেচকদের মানবতাবিরোধী অপকর্মে বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলা। তাই নির্মমতার আঘাত কত পীড়াদায়ক বাঙালিকে তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রিয়জনহারা, বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে আসা মানবতাবাদী মহৎপ্রাণ। পিতার আদর্শ, ত্যাগ এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার বিরাট পাঠশালায় যিনি দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি তার কর্মেই নন্দিত নারীর আসন গ্রহণ করে আছেন। আজ রোহিঙ্গা সঙ্কটের ভয়াবহ দুর্যোগকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও সময়োচিত পদক্ষেপ প্রশংসার দাবিদার। প্রধানমন্ত্রীর রোহিঙ্গা সম্পর্কিত মানবিক বিষয়টিতে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় দেশের বিশিষ্টজন এবং আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, নাফ নদী পেরিয়ে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর ঢেউ ‘মানবিক’ দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, না ‘কূটনৈতিক’ কারণে তাদের আটকে রাখা উচিত? এই প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন সবদিক বিবেচনা করেই রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের এই অবস্থানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান সময়োচিত ও যথার্থ। গত ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখায় এসে জড়ো হতে শুরু করলে প্রথম দিকে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসন তাদের কড়া পাহারায় রেখেছিল। সীমান্ত এলাকায় ছিল কয়েক স্তরের নজরদারি। ওপাশে ভিড় বাড়তে থাকলে এবং আরাকানে সহিংসতার ব্যাপকতর মাত্রা স্পষ্ট হতে থাকলে ৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। গণভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে মূলত পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় আগত উদ্বাস্তুদের সঙ্গে ‘অত্যন্ত মানবিক আচরণ’ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। পরদিন সকাল থেকেই সীমান্তে শূন্যরেখায় পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে।

রোহিঙ্গা ক্ষত বাংলাদেশের জন্য বেশ পুরনো একটি ব্যাধি। স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশে বিভিন্ন কারণে রোহিঙ্গা সমাগম ঘটতে থাকে। তখন থেকে তেমন একটা কড়াকড়ি না থাকায় বাংলাদেশ আজ রোহিঙ্গা ভারে নত। এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের জন্য আরো কঠিন অবস্থা অপেক্ষা করছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ২০১২ সালে ফের রাখাইন স্টেট অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে তিনি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। আবার সাম্প্রতিক সংকটে তিনি একদিকে যেমন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা নারী-শিশুসহ রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন, তেমনই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান খুঁজছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের মতে, এটাই ‘রাইট এপ্রোচ’ বা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। অপরদিকে সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল।

সম্প্রতি গঠিত কফি আনান কমিশনকেও এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছে ঢাকা। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিয়েই বাকি আলোচনা অগ্রসর হতে পারে-আনান কমিশনের এই সুপারিশে বাংলাদেশেরই অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে চতুর্মুখী উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, সরাসরি মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সমর্থন ও সহায়তা লাভের প্রচেষ্টা। তৃতীয়ত, বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। জাতিসংঘ, ওআইসি, ইইউ এবং আসিয়ানের মতো জোটে রোহিঙ্গাদের অধিকার, তাদের ওপর পরিচালিত নিপীড়ন এবং শরণার্থীদের আশ্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমিত সামর্থ্য তাদের মনে করিয়ে দেওয়া। চতুর্থত, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যাতে করে রাখাইনের চিত্র সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী ঢাকায় বিভিন্ন দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থার দফতরের সঙ্গে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ নিয়মিত কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার উদ্যোগী তৎপরতাই এক দিন শান্তি ফিরিয়ে আনবে-এটাই বাংলাদেশের একমাত্র প্রত্যাশা।

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist