এস এম মুকুল

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বিশ্লেষণ

শান্তির দূতকে খোলা চিঠি

বিশ্বব্যাপী আজ ধিক্কার উচ্চারিত হচ্ছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির বিরুদ্ধে। যাকে এত দিন মানুষ জানত মানবতাবাদী! শান্তির দূত হিসেবে! তার রহস্যময় আচরণে আজ তার দেশে লঙ্ঘিত হচ্ছে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলিমদের মানবাধিকার। ফলে বিশ্বের মানুষ তাকে ধিক্কার জানাতে বাধ্য হচ্ছে। রোহিঙ্গারা মুসলিম হোক বা বৌদ্ধ-তারা মানুষ তো। মিয়ানমার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করুক কিংবা না করুক-তারা তো শত শত বছর ধরে বংশানুক্রমে ওই ভূখন্ডেরই অধিবাসী। সংখ্যাগুরু হোক কিংবা সংখ্যালঘু-জন্মসূত্রে রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রের অন্য সবার মতো সমান নাগরিক অধিকার প্রাপ্য। অং সান সু চিকে তার নীরবতা ভাঙার জন্য অনেকে খোলা চিঠি লিখেছেন।

‘হে শান্তি রক্ষার শপথকারী মানবী অং সান সু চি, ক্ষমতার মোহে আজ সব ভুলে গেলে তুমি। আজ বিশ্ববিবেক তোমায় দেখে হতবিহ্বল, বাকরুদ্ধ, অস্থির। তোমার উপাধি তাই আজ দানবী! তুমি নিজেকে ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক বলতে। অথচ সারা বিশ্ব রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয়ে তোমার ন্যায়পরায়ণতার এক বীভৎস নমুনা দেখছে। এই ‘গণহত্যা’ এই ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ তোমাকে কোথায় নামাতে পারে তা হয়তোবা সময়ই বলে দেবে। তোমার দেশে, তোমার ক্ষমতার বলয়ের ছায়াতলে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে সারা বিশ্বে যখন তোলপাড়, তখন তোমরা দাবি করছ সবই অপপ্রচার!’

আর কিইবা বলা যেতে পারে। একসময়ের মানবতার পক্ষের প্রতীক হয়ে ওঠা অং সান সু চি শান্তিতে নোবেল বিজয়িনী এখন অন্যতম ঘাতক হিসেবে বর্বরোচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ। এই বর্বরোচিত ভূমিকা কিংবা নীরবতা মানবতার জন্য লজ্জার এবং ঘৃণার। আমরা যদি একটু অন্যভাবে চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাব এই সু চির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার শুভসূচনা হয়েছিল বিশ্বের মানবতাবাদী জনগণ ও নেতৃবৃন্দের সোচ্চার হয়ে ওঠার কল্যাণে। তিনি নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে নিজেই গৃহবন্দি হয়েছিলেন নিজ দেশে। তার এমন বন্দিদশায় পৃথিবীময় সাধারণ মানুষ এবং নন্দিত নেতারা তার মুক্তির পক্ষে আওয়াজ তুলেছিলেন বলেই তিনি আজকের অং সান সু চিতে পরিণত হতে পেরেছেন। সু চি হয়তোবা ভুলেই গেছেন তার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পেছনে বিশ্বের মানবতাবাদী শক্তির অকুণ্ঠ সমর্থন বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ অংশীদার। কিন্তু অবাক করার ব্যাপারটি হচ্ছে, এই নির্যাতনবিরোধী নেত্রী যিনি নিজে গৃহবন্দিত্বের শিকার ছিলেন সেই তিনিই আজ অকাতরে নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছেন নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর। কেন জানি নোবেল শান্তি পুরস্কারটি ক্রমেই বিতর্কিত হচ্ছে। নরওয়ের নোবেল কমিটি কোন বিচারে এই পুরস্কার দিচ্ছে তা নিয়েও ইতোমধ্যে বহু প্রশ্ন উঠেছে। আমরা জানি, পৃথিবীতে শান্তি বিরাজমান রাখার ক্ষেত্রে বা বিস্তারে ভূমিকার জন্য নোবেল পুরস্কারের অন্যসব ক্যাটাগরির মধ্যে শান্তি পুরস্কার অন্যতম একটি। কিন্তু এই পুরস্কার বিজয়ীরা পূর্বাপর কতটা শান্তি বিরাজে তৎপর ভূমিকা রাখতে পারছেন বা পেরেছেন তা অবশ্যই ভাবান্তরের সৃষ্টি করে। শুধু সু চিই নন আমাদের দেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আমরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কেন নোবেল পেলেন অথবা নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর তারা স্বদেশে এবং বিশ্বের মানবতায় এমন কী ভূমিকা রাখছেন সে প্রশ্ন তো যে কেউই তুলতে পারেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী ধর্মযাজক শান্তিতে নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটু এক খোলা চিঠিতে সু চিকে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, ‘আমি এখন বৃদ্ধ, জরাগ্রস্ত। আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীন বিষয়ে নীরব থাকার যে অঙ্গীকার আমি করেছিলাম, তোমার দেশে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের দুর্দশা দেখে গভীর দুঃখের সঙ্গে সেই নীরবতা আমি ভাঙছি। ২০১০ সালে তোমার গৃহবন্দি অবস্থার মুক্তির আনন্দ আমরা উদ্যাপন করেছিলাম। ২০১২ সালে আমরা তোমার বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনকে উদযাপন করেছিলাম। জনজীবনে তোমার আবির্ভাব রোহিঙ্গা লোকজনের বিরুদ্ধে সহিংসতার ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগকে প্রশমিত করেছিল। কিন্তু এখন সেখানে অব্যাহত নিপীড়ন, নীরব গণহত্যা আমাদের হৃদয়কে কষ্ট ও আতঙ্কে ভরপুর করে তুলছে। আমরা জানি, তুমিও জান, মানুষের চেহারা এবং তাদের প্রার্থনা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু বাইরের দিক থেকে আমরা সবাই সমান। সবাই মিলে একটি মানব পরিবার। সুতরাং প্রাকৃতিকভাবে বৌদ্ধ, মুসলিমদের বা ইহুদি, হিন্দু, খ্রিস্টান কিংবা অন্য কোনো ধর্মবিশ্বাসীর মধ্যেও কোনো পার্থক্য নেই। এমনকি কোনো ধরনের অন্ধবিশ্বাস ছাড়া আমরা ভালোবাসার জন্য জন্মগ্রহণ করেছি। অসাম্য প্রাকৃতিকভাবে আসে না, এটা শেখানো হয়।’ ডেসমন্ড টুটুর এই চিঠিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন এই (অ)শান্তির দূত! মানুষ যার কাছে বড় পরিচয় নয়, সে আগে মানুষ হতে পারে না, শান্তির দূত হওয়া তো অনেক দূরের কথা। নোবেল পুরস্কার কমিটির কাছে জানতে ইচ্ছে করে- নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে না নিন, নিদেনপক্ষে এই দূতের এমন মানবতাবিরোধী অপকর্মের বিষয়ে সোচ্চার হবেন।

রোহিঙ্গাদের ধর্ম পরিচয় বড় নয়। রোহিঙ্গারাও মানুষ-এটাই তাদের বড় পরিচয়। যদি এটা ধর্মীয় ইস্যু হয়, তবে মিয়ানমারে মুসলিমরা যেমন সংখ্যালঘু তেমনি বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু হিসেবেই বিবেচিত। রোহিঙ্গারা জন্মসূত্রে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে মৌলিক অধিকারগুলোর সবই পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি- মিয়ানমারের জান্তা সরকার সর্বোপরি জনসাধারণও এই রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। কিন্তু আমরা দেখে আসছি, রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নে সু চি বরাবরই নীরব। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হচ্ছে, তিনি ‘রোহিঙ্গা’ নামটিও নাকি মুখে আনেন না। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে আর সু চি সেই নীতির আলোকে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করছেন। এ কথা বুঝতে আর কারো বাকি থাকার কথা নয় যে-রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চিকে নীরব থাকার চাপ সরকার নিশ্চিতভাবেই দিচ্ছে এবং সু চিও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও এখনো সরকারে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। প্রকৃত বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অং সান সু চি জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন বন্দি শিবিরে। যদিও মানবিক নির্যাতনের বিপক্ষে অবস্থানের কারণেই তার ওপর সামরিক জান্তার এমন স্বদেশ নির্বাসন হয়েছিল। কিন্তু তার এমন পরিণতির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল বিশ্ব বিবেক। ফলে তিনি মুক্ত হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার বলয়ে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। পেয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। এটাই ছিল অতীত ইতিহাস। কিন্তু অতীতের তিক্ততায় জীবনের অনাকাক্সিক্ষত ঈর্ষণীয় এই সাফল্যে অমৃততুল্য ক্ষমতার স্বাদ কেইবা হারাতে চায় বলুন। তাই মানবতার পক্ষের আন্দোলনে বিজয়ী হলেও তিনি অবস্থান থেকে সরে গেছেন বা বাধ্য হয়েছেন দুটোই সত্যি। কিন্তু কেন? সহজাত রাজনীতির দিকটি বিবেচনা করলেই বোঝা যায় মিয়ানমার একটি বৌদ্ধপ্রধান দেশ। সেখান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, রাষ্ট্রের কর্ণধার, রাজনৈতিক বলয়, সামরিক বলয় সবখানে বৌদ্ধবেষ্টিত ক্ষমতার স্রোত। রাজনীতিতে ক্ষমতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্ষমতায় না গেলে রাজনীতির কোনো মূল্য নেই বা ক্ষমতাহীন রাজনীতি বাক্সবন্দি স্বপ্নের মতো।

নির্বাচনী প্রচারে রাখাইন রাজ্যে গিয়ে সু চি বলেছিলেন, জাতিগত ও ধর্মীয় বঞ্চনার হাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করা জরুরি। দেশের সব মানুষকে এক হতে হবে। একে অন্যের প্রতি ঘৃণা ও ভীতি প্রদর্শন কোনো সফলতা বয়ে আনে না। সরাসরি না হলেও মূলত তার এ কথায় ভরসা পেয়েছিল রাখাইনে বসবাসরত সংখ্যালঘু নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানরা। রোহিঙ্গারা ভেবেছিল, সু চির গণতান্ত্রিক সরকার তাদের রাষ্ট্রীয় অধিকার ফিরিয়ে দেবে; সুখে-শান্তিতে তারা মিয়ানমারে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু এই সু চিই অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে মুসলমানদের নির্যাতনের মাধ্যমে উচ্ছেদ করার অমানবিক পদক্ষেপ নিয়ে। দুঃখজনক সত্যি হলো, সু চির নেতৃত্বে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা হলেও শান্তি ফেরেনি রাখাইনে। ২০১২ সালে সু চি ভারত সফরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ‘বেঙ্গলি’ হিসেবে অভিহিত করে তার রোহিঙ্গা নীতির আভাস দিয়েছিলেন। ঢাকা দফায় দফায় এর প্রতিবাদ জানানোর পর মিয়ানমার ‘বেঙ্গলি’ শব্দ ব্যবহার না করার আশ্বাস দিলেও বরাবরই তার বরখেলাপ করেছে। নির্মম বাস্তবতা হলো- সু চি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে চান। তাই রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক হওয়া না হওয়াটা তার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিষয়ে নীরব থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের সঙ্গে মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চি বিশ্বমানবতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। শান্তিতে পুরস্কারজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক জোডি উইলিয়ামস, ইরানের শিরিন এবাদি, লাইবেরিয়ার লেইমাহ বোয়িসহ নোবেলজয়ী আরো চার নারী দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক চিঠিতে লিখেছেন- আপনার নীরবতা নোবেল শান্তি পুরস্কার ও এর মর্যাদায় একটি কালো এবং বিব্রতকর ছায়া ফেলেছে। ওই মর্যাদা রক্ষা করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বনন্দিত এমন নেত্রীদের কথায় সু চি কি কর্ণপাত করবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কোনো দেশের নাগরিক যদি অন্য দেশে রিফিউজি হয়ে থাকে এটা সে দেশের জন্য সম্মানজনক নয়। এটা মিয়ানমারকে উপলব্ধি করতে হবে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, অং সান সু চি কিংবা মিয়ানমারের বৌদ্ধদের আত্মমর্যাদাবোধ আসলে আছে কি না-সেটাও একটা দেখার বিষয়!

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist