অলোক আচার্য

  ২৪ আগস্ট, ২০১৭

মতামত

ক্ষমতার দম্ভে ধর্ষক

বরগুনায় শ্রেণিকক্ষে ঢুকে স্বামীকে আটকে রেখে শিক্ষিকাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের মতো পবিত্র জায়গাও ধর্ষকরা বাদ রাখল না। তাহলে নারীরা কোথায় আশ্রয় নেবে? নিজের ঘর, রাস্তাঘাট, অফিস, স্কুল কোথাও হায়েনাদের ভয়মুক্ত থাকতে পারছে না নারীরা। আর বয়সের তো কোনো রাখঢাক নেই। সাত মাস থেকে সত্তর বছর। ধর্ষণের শিকার হয়ে চলেছে কত নারী। কেউ কারো বোন, কারো স্ত্রী, কারোবা আত্মীয়। হামাগুড়ি দিয়ে যেন সাপের মতো ফণা তুলে প্রতিদিন ধর্ষকরা ঘুরে বেড়ায়। ওঁৎপেতে থাকে অন্ধকারে। তারপর নৃশংস থেকে নৃশংসতম হয়ে ওঠে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এটি একটি ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে চলেছে। শুধু প্রতিষেধকটা জানা নেই। প্রতিষেধক আসবে কোত্থেকে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পেছনে কোনো ক্ষমতাবানের দাপট থাকে। সে বা তারা মিটমাট করার জন্য উঠে-পড়ে লাগে। বরগুনায় নাকি ধর্ষকরা সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্তি। আসলে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা ঠিক কতটা? অর্থবিত্তের ক্ষমতা কি মানুষকে এত ঔদ্ধত্যপূর্ণ করে তুলতে পারে? বগুড়ায় মেয়েকে ধর্ষণ করে মা-মেয়েকে মাথা ন্যাড়া করার ঘটনার হোতা বহুল সমালোচিত তুফান এখন কারাগারে আটক। কারাগারে থাকা অবস্থায় সে একটু আলাদা খাতির পাচ্ছে বলে কয়েকটি অনলাইনে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর নাম কি ক্ষমতা? একজন-দুজন করে প্রতিদিন সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে। ধর্ষণ মানে এক ধরনের মৃত্যু। তবে তা শারীরিক মৃত্যু নয়, মানসিক মৃত্যু। বেঁচে থেকেও সে মরে থাকে। আবার ধর্ষণের পর মুখ বন্ধ করতে মেরেও ফেলা হয়। নৃশংস থেকে নৃশংসতম ঘটনা আমরা দেখে চলেছি। সভ্য সমাজে অসভ্য বর্বরদের পদচারণায় ক্রমেই ধরণি ভারী হয়ে উঠছে। এর থেকে যেন পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় নেই। পশুবৃত্তি যেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে চেপে বসেছে, সেখান থেকে আলোর পথ ও মনুষ্যত্বের পথ দেখানোর কেউ নেই। সমাজে ধর্ষণকারীদের দাপটই বেড়ে চলেছে।

পাকিস্তানিরাও এক সময় এ দেশের লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জত নিয়েছিল। তারা নাকি নারী দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটেও নিত। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করত তাদের যৌনাঙ্গ। কিন্তু তারা তো পাকিস্তানি ছিল। ইতিহাস তাদের বর্বর বলেই সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু আজ যা হচ্ছে তা করছে কারা। নিজ দেশের চেনা মুখগুলোর হাতে প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হতে হবে স্বাধীন দেশের নারীদেরÑতা কি কেউ ভেবেছিল? মনে হয় ভাবেনি। ভাবেনি বলেই কবি শামসুর রাহমান তার কবিতায় লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা তুমি গ্রাম্য মেয়ের অবাধে সাঁতার।’ যেখানে সমাজের আনাচে-কানাচে ধর্ষকরা ঘুরে বেড়ায়, সেখানে অবাধে সাঁতারের প্রশ্নই আসে না। আমাদের মেয়েরা তো বন্দি। অনেক ক্ষেত্রেই আজকাল আবার পরোক্ষভাবে ধর্ষণের শিকার নারীর দিকেই অভিযোগের আঙুল তোলা হয়। আসলে সাপ যাকে কোনো দিন দংশন করেনি সে কি পারে বিষের যন্ত্রণা অনুভব করতে? যে পরিবারের একটি মেয়ে ধর্ষণে শিকার হয় সেই পরিবারই যন্ত্রণা বোঝে। কারণ সমাজটা বড় অদ্ভুত। ধর্ষিতাকেই নানা কটু কথা শুনতে হয়। আবার ধর্ষকদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। মেয়েটির কত দোষ চোখে আঙুল দিয়ে বের করে দেয়। এই সাফাই গাওয়ার প্রবণতা ধর্ষকদের উৎসাহ দেওয়ারই নামান্তর। কিন্তু আমরা তো একটা ধর্ষক মুক্ত সমাজ চাই।

সভ্য সমাজে অসভ্য হায়েনার নাচ আর কতকাল দেখতে হবে কে জানে। অবশ্য সভ্যতার দোহাই দিয়ে আজকাল আমরা যা করছি তাতে আর নিজেদের সভ্য বলা যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। পোশাকে-আশাকে রুচিশীল হলেই তাকে সভ্য বলা যায় না। অথবা গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সুটেড-বুটেড হয়ে রাস্তায় বেরুলেই সভ্য সমাজের অংশ হওয়া যায় না। সভ্যতা তো থাকে প্রথম অন্তরে, তারপর তার বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে। এ নিয়ম সব সমাজের সব দেশের। আমরা পোশাকে-আশাকে যতটা সভ্য হয়েছি আচরণে কি তা প্রকাশ করতে পেরেছি। বরং উল্টোটাই প্রকাশ করছি। আমরা কেবল পোশাকেই সভ্যতাকে আনতে পেরেছি। মনে তো সেই আদিমতা। সাত মাসের শিশুর ধর্ষণের খবরটি ছিল পাবনার একটি স্থানীয় পত্রিকায়। ঘটনাটি ছিল শাহজাদপুরে। খরব দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কয়েক দিন আগে অ্যাকশন এইডের গবেষণায় নারীদের প্রতি নৃশংসতার একটি চিত্র উঠে এসেছে। সেখানে দেখানো হয়েছেÑ ঢাকা শহরে ৫৬ ভাগ নারী ঘরের বাইরে যেতে পারে না, নিরাপত্তার অভাবে ২৬ ভাগ নারীকে ঘরের বাইরে যেতে দেয় না পরিবার, নিরাপত্তার অভাবে ৯৩.৫ ভাগ নারী টয়লেট ব্যবহার করতে পারে না, ভিড়ের কারণে ৫৮ ভাগ নারী গণপরিবহনে উঠতে পারে না, চালক অথবা তার সহকারী অথবা যাত্রীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ২২.০৫ ভাগ নারী। নারীর জন্য এতটা অনিরাপদ শহর ঢাকা। এর বাইরে আরো প্রতিবন্ধকতা আছে। এত প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দেশ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

প্রাচীন সমাজে ছেলে আর মেয়েতে ছিল বিস্তর বিভেদ। সেই পরিবারের দেখা দৃষ্টিভঙ্গি আজও অনেক পরিবারেই রয়েছে। নির্যাতনের শুরুটাও হচ্ছে এই পরিবার থেকেই। মেয়েদের যৌন নিগ্রহের ঘটনা অনেক সময়েই পরিবারের পরিচিত জনদের কাছ থেকে হয়। এটা আরো বড় দুর্ভাগ্যের। কারণ ভয়ে বেশিরভাগ সময়েই তারা বিষয়টি চেপে যায়। আবার বলেও তেমন প্রতিকার পাওয়া যায় না। এভাবে পুরুষ সমাজের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা নিয়ে সে বড় হয়ে উঠতে থাকে। তারপর এক সময় অবাক হয়ে লক্ষ করে বাইরের পৃথিবীটা তার জন্য অনেক বেশি অনিরপাদ। শরীরনির্ভর ভালোবাসার এই পৃথিবীতে তার শরীরের দিকে এক শ্রেণির শকুনের চোখ। পথেঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বাজারে, কর্মক্ষেত্রে এরা ঘুরে বেড়ায়। সমাজের সাধারণ ভালো মানুষের সঙ্গে তারাও চলাফেরা করে। কিন্তু দৃষ্টিটা আলাদা। সে একা হাঁটতে পারবে না, বাসে বা রেলে চড়তে পারবে না। যেখানে সেখানে রয়েছে বিষাক্ত কিছু মানুষ। যারা নখে বিষ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিদিন গণমাধমে এসব বিষাক্ত মানুষের বিষ ছড়িয়ে দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। শারীরিকভাবে হেনস্তা ছাড়াও প্রতিনিয়ত রাস্তায় ভিড়ে বখাটেদের লোলুপ চাহনি আর নোংরা ইঙ্গিতসহ শারীরিক নির্যাতনের ভয়।

যারা ধর্ষক তাদের কি বোন নেই। তারাও কি তার ভাইয়ের মতো অন্য কাউকে ভয় পায়। সে কি আদৌ জানে তার পরিচিত মুখ কতটা ভয়ঙ্কর। অনেক পরিবারে মেয়ে জন্ম হলে যেন পরিবারে আনন্দিত হওয়ার বদলে কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা যেত এবং আজও যায়। কন্যাশিশু জন্ম হলে পরিবারের সবার কপালে এই ভাঁজ পড়ত। মেয়েদের ক্ষেত্রে ছিল পদে পদে নিষেধাজ্ঞা। তাদের পৃথিবী ছিল ছোট। আজ তাদের চলায় সেসব বাধা নেই। তবে চলার পথ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপদের শঙ্কাও বেড়েছে বহুগুণ। আগে মেয়েদের এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না; এখানে মেয়েদের থাকা ঠিক নয় বা মেয়েরা এ কাজ করতে পারে নাÑএসব বলা হতো। তাদের নানাভাবে ছোট করা হয়েছে, বানানো হয়েছে পুতুল। নানা রকম নিয়মের বেড়াজালে বন্দি ছিল মেয়েদের জীবন। মেয়েদের ঘরের বাইরে বের হওয়াই ছিল প্রায় নিষেধ। একটা সময় মেয়েদের লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল কম। সে অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে বেগম রোকেয়া কামালের মতো মহীয়সী নারীরা এগিয়ে এসেছেন। তারা দেখিয়েছেন পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও সমান অবদান রাখতে পারে। আজ যোগ্যতার সঙ্গে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা বিশ্বরাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে সমান ভূমিকা পালন করে চলেছে। পিছিয়ে নেই কোনো ক্ষেত্রেই। মেয়েরা লিখছে, পড়ছে এবং প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে।

ছেলেদের থেকে মেয়েদের পাসের হার বেশি। শুধু শিক্ষায় নয়, বরং অন্য অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। সমরক্ষেত্রে যুদ্ধ বিমান নিয়ে শত্রুর দিকে উড়ে চলেছে নারীরা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি অবদান রেখে চলছে না। প্রযুক্তির উৎকর্ষে পৃথিবী এগিয়েছে। সেই সঙ্গে এগিয়েছে মানুষের ধ্যানধারণা চিন্তাচেতনা। চেতনার উৎকর্ষে আজ নারী-পুরুষের বিভেদ, হীনম্মন্যতা সমাজ থেকে কমছে। কিন্তু আজও আমরা পারিনি সমাজ থেকে ছেলেমেয়ের সমান অধিকার সমভাবে নিশ্চিত করতে। পারিনি আমার মেয়ের যাত্রা নির্বিঘœ করতে।

আমরা ধর্ষকের শাস্তি দেখতে চাই। আমাদের মেয়েদের নিরাপত্তা চাই। সিলেটে মা-মেয়ে ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে। এতসব ঘটনার কোনোটাই যেন কম গুরুত্ব বহন করে না। ধর্ষণ চিত্রের এই ভয়াবহতা যে কেবল বাংলাদেশেই তা নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ধর্ষণের ভয়াবহ চিত্র রয়েছে। বছর পাঁচেক আগে দিল্লিতে নির্ভয়া নামে একটি মেয়েকে নৃশংসভাবে অত্যাচারের পর কয়েক দিন আগেই এ রকম ঘটনা ঘটেছে। সেখানে ধর্ষণ শেষে প্রথমে মেয়েটির মুখ ইট দিয়ে থেঁতলে পরে গাড়ি দিয়ে পিষে দেওয়া হয়েছে। তারপর রাস্তার শেয়াল কুকুররা ছিঁড়ে খেয়েছে। এই হলো অবস্থা। ধর্ষণ এবং তার পরবর্তী নৃশংসতা এতই ভয়ঙ্কর যে, আদিমতাকেও হার মানায়।

আগেই বলেছি পোশাকে নয়, সভ্যতার জন্ম হয় মনে। মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন অসম্ভব। মেয়েদের ভোগের বস্তুর দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার আগে একবার নিজের পরিবারের দিকে তাকাই। আজ যারা ধর্ষণ করছে তাদের পরিবারের মেয়েদের লজ্জা অনেক বেশি। তারা তো জানতও না যে, তার আশপাশেই এ রকম একজন ধর্ষক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই সবার আগে নিজের মনকে সভ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist