ড. মশিউর রহমান মৃধা

  ২৩ জুলাই, ২০১৭

নন্দনতত্ত্ব

সত্যের মোড়কে শৈল্পিক কারুকাজ

সত্য, একটি শব্দ মাত্র নয়। মানবজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সত্য এবং সুন্দর দুয়ে মিলে জীবনকে সফল, সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ করে তোলে। সত্যকে ধারণ করে শুরু করা জীবন সফলতার মুখ দেখতে পায়। চমৎকার করে বলেছেন কবি চ-ীদাস-‘শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ বোঝা গেল মানুষকেই সত্যের সব দায়দায়িত্ব নিতে হয়। মানুষকেই সত্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হয়, সখ্য গড়ে তুলতে হয়। যদিও সত্য প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠায় নানা বাধাবিপত্তি রয়েছে। যে মানবজীবন সত্য প্রকাশে আপসহীন, সে জীবন জয় ও সফলতার মুখ দেখেছে, দেখে এবং দেখবেই।

সত্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সৃজনশীলতা। সৃজনশীলতার মূল ভিত্তি চিন্তা বা ভাবনা। চিন্তার ফলাফলে রয়েছে মানবজীবনের সফলতা ও সৃষ্টি। জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা-দর্শন-সাহিত্য; যে দিকেই তাকাই না কেন সবকিছু ঘিরে রয়েছে সত্য। মানুষকে মনুষ্যত্বের ভারবাহী করে গড়ে উঠতে প্রয়োজন নির্ভেজাল সত্য, নিখুঁত সত্য। শুধু আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিবেচনায় নয়, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত; মানুষ হয়ে মানুষ তৈরি করার কাজ শিক্ষকের। সুতরাং শিক্ষক মাত্রই সত্যের ধারক-বাহক। যে মানুষ সত্যকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধারণ করে, সত্যই সে মানুষকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। শিক্ষকের মহান দায়িত্ব শিক্ষার্থীকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার মন্ত্র দেওয়া। সুতরাং সত্য এবং শিক্ষকতা দুই-ই অভিন্ন আত্মা। সত্যের নিজস্ব শক্তি রয়েছে, রয়েছে অপরিসীম সাহস। যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্য নির্ঘুম প্রকাশের অপেক্ষায়। অনুরূপ শিক্ষকের ধ্যান-জ্ঞান অষ্টপ্রহর সত্যের সঙ্গে বসবাস।

সত্য নিয়ে একটি গল্প। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘সেরা লেখা’ ১ম খ- থেকে উদ্ধৃত। বাজিকর খেলা দেখায় বানর এবং ছাগল নিয়ে। এক দিন দইয়ের হাঁড়ি, বানর-ছাগল পুকুর পাড়ে রেখে গোসল করতে নেমেছেন বাজিকর। এই সুযোগে বানর হাঁড়ির সমস্ত দই খেয়ে ফেলে। বাজিকর বুঝতে পারলে বিপদ হবে এই ভেবে ফন্দি আঁটে বানর। হাঁড়ির অতলে লেগে থাকা দই চেটে ছাগলের মুখে লাগিয়ে দেয়। বাজিকর গোসল সেরে ছাগলকে দায়ী ভেবে ভীষণ প্রহার করে। এই সময় একজন লোক এগিয়ে আসে এবং সত্য ঘটনা বাজিকরের সামনে উপস্থাপন করে। বাজিকর ভুল বুঝতে পারে। প্রশ্ন হলো-যিনি বাজিকরের ভুল ভাঙালেন তিনি মানুষ কি না? প্রকৃতপক্ষে তিনি মানুষরূপী সত্য। সত্য এমনই। কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পায়, সামনে এসে দাঁড়ায়। শিক্ষকতায় সত্য তেমনি অবিনাশী আরশি হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে এবং থাকবে।

শিল্প-শৈল্পিক, সৌন্দর্য-সংস্কৃতি এক জীবনে মানুষকে আনন্দ ভুবনে অবগাহন করায়। শৈল্পিক স্পর্শ ছাড়া একজন মানুষ আনন্দময় জীবনের নাগাল পায় না। এই ক্ষেত্রে জানার আগ্রহই শিল্প চেতনার মূল উৎস। শিল্প এক প্রকার শক্তি। বিশেষত, মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করার, মানুষকে আত্মস্থ করার এবং মানুষকে জয় করার উপায় হলো শিল্প। মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য, উদ্বুদ্ধ করার জন্য শিল্প শক্তির বিকল্প কিছু নেই। মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে নিহিত আছে শিল্প-সাহিত্যের সব উপকরণ। যা কিছু সত্য, সুন্দর, মনোমুগ্ধকর তাই শৈল্পিক। প্রকৃত কথায় শিল্পে এবং সাহিত্যে একনিষ্ঠ সাধনা অত্যাবশ্যক। জীবনের অন্য অনুষঙ্গে ফাঁকি চললেও শিল্পে সাহিত্যে তা অচল। অন্যদিকে শিল্পী শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে স্বাধীন। শিল্পীর শৈল্পিক কারুকাজে থাকে অসীম স্বাতন্ত্র্যবোধ। অন্যায়-অনাচার-কদর্যের মধ্যে সৌন্দর্যের নিপুণ আহ্বান রাখেন শিল্পী। শিল্পী বিশ্বমানবতার আহ্বান জানান শৈল্পিক কর্মযজ্ঞে। তেমনি শিক্ষার অনেকগুলো সংজ্ঞার মধ্যে অন্যতম একটি হলো-ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-দেশ-জাতি তথা বিশ্বের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য শিক্ষা সর্বোচ্চ শিল্পকর্ম। নিঃসন্দেহে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম শৈল্পিক কারুকাজ।

শিক্ষকের কাজ শিক্ষার্থীকে জাগিয়ে দেওয়া, শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভাগুলোতে আলোড়নের ঢেউ দেওয়া, শিক্ষার্থীর ভাবনা, কল্পনাশক্তি, মূল্যবোধ, জীবনবোধ ইত্যাদি সুকুমার বৃত্তিগুলোকে তার সামনে মেলে ধরা, তুলে ধরা। শ্রেণিকক্ষকে রসময়, আনন্দময়, অর্থবহ করার সব দায় শিক্ষকের। শিক্ষকের কথা বক্তৃতা নয়, বাণী। অমৃততুল্য শিক্ষকের কথায় থাকে শিল্পের আকর্ষণ, শৈল্পিক মূর্ছনা। সে অর্থে শ্রেণিকক্ষে, এমনকি শ্রেণিকক্ষের বাইরেও শিক্ষকের কথা নিছক কথার কথা নয়। এমন যদি হয়, তবে তা কোনো শিক্ষকের কথা নয়, তা হতে পারে নামে মাত্র শিক্ষকের কথা। শিক্ষকের মুখ নিঃসৃত বাণী, শিল্পীর তুলীর আঁচড় আর সাহিত্যিকের জীবন আস্বাদনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

এ কথা সর্বজনবিদিত যে, মানব পরিচয়ের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য শিক্ষা। প্রাণীকুল থেকে মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার নাম শিক্ষা। অর্থাৎ ‘মানব পরিচয়ে জন্মেছে যে, শিক্ষার আলোতে উত্তাপে বাড়বে সে।’ এই অর্থে শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্যটি শিক্ষক মাত্রই জেনে নেওয়া জরুরি। শিক্ষকের শিক্ষাদান, পাঠদান শিক্ষার্থীর দেহে-মনে পরিপূর্ণতার আয়োজন করছে কি না শিক্ষকই তা অনুধাবন করতে পারেন। জ্ঞানোত্থিত অনুভূতি অর্থাৎ জ্ঞান হতে যে অনুভূতির জন্ম হয় সে রকম ভাবাবেগ শিক্ষকের জন্য নিত্যপ্রয়োজন। অন্য কথায় এটি পর্যবেক্ষণ-অভ্যাস-অনুশীলন-চর্চা। বলা হয়ে থাকে, মানুষ যেমন, তার স্বপ্নও তেমনি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-‘পাত্র যত বড় জল তাহার চেয়ে বেশি ধরে না।’ শিক্ষকতায় এই বিষয়টি খুবই অপরিহার্য। শিক্ষা-স্বপ্ন, শিক্ষকের জীবনবোধ-সৌন্দর্যবোধ-জীবনাগ্রহ তৈরি করে। শিক্ষক মানে শিল্প সাধনার নিটোল কারিগর, গড়ে তোলেন বস্তুনিষ্ঠ মানবাত্মা।

শিক্ষক নিশ্চিত চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। জ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখা-উপশাখায় শিক্ষক অবাধে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণকারী, উদ্ভাবন করেন জ্ঞানের নতুন দিগন্ত। এজন্যে শিক্ষকের অভ্যাস-অনুশীলন-চর্চায় নিরন্তর থাকবে শৈল্পিক মনোভাব ও অভিজ্ঞতা। বুদ্ধিনির্ভর, যুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকের চাই কৌতূহল প্রবৃত্তি। শিক্ষকতার ভিত্তি কৌতূহলী মনোভাব। কৌতূহল থেকে বুদ্ধি অন্বেষণের জন্য চাই সদা জাগ্রত ইচ্ছেশক্তি। কৌতূহলের সঙ্গে কৌশলের আত্মীয়তা। জ্ঞান আহরণের জন্য, বুদ্ধি বিকাশের জন্য বিশ্বাস-ধৈর্য-পরিশ্রম একান্ত সঙ্গী হয়ে যায় শিক্ষকের। শিক্ষকতায় এগুলো নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। শিক্ষকতায় প্রতিনিয়ত থাকে নতুন সত্যকে গ্রহণ করার প্রবণতা, থাকে মানবিক মূল্যবোধের আকুল প্রত্যাশা।

শিক্ষকতা একটি সচেতন, সতর্কতামূলক বিষয়। শিক্ষকের পাঠদান, শিক্ষাদান, আদেশ, উপদেশ যেন শিক্ষার্থীর জীবনে দায় হয়ে না দাঁড়ায়, বোঝা না হয়। শিক্ষকের সামগ্রিক আচরণ, চিরায়ত ধারায় শিক্ষার্থীর মনোজগতে চিরন্তন প্রভাব ফেলে। এই গল্পটি বিষয়টিকে সহজ করে দেবে। একজন পঙ্গু ভিক্ষুক বন পেরিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে ভিক্ষা করে। ভিক্ষুকের ধারণা, ভিক্ষা করেই তাকে দিনাতিপাত করতে হবে। ক্লান্ত ভিক্ষুক স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা জানায়-হে পরম করুণাময়, ভিক্ষা করেই যেহেতু আমাকে জীবন অতিবাহিত করতে হবে অন্তত একটা ঘোড়া পাঠাও যাতে ঘোড়ায় চড়ে আরামে ভিক্ষা করতে পারি। এমনি ভাবনায় দিন যাচ্ছে, এক দিন কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যার কিছু পূর্বে দূর থেকে ঝোপের আড়ালে একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ভিক্ষুক। ভিক্ষুক উচ্ছ্বসিত। ভাবল, তার মনোবাসনা পূর্ণ হতে যাচ্ছে। ভিক্ষুক ধীরে ধীরে ঘোড়ার কাছে যেতেই অনতি দূরে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা দারোগা খাট্টাসের মতো চেঁচিয়ে উঠল। ভিক্ষুককে গালাগাল করতে লাগল, বিলম্বে আসার জন্য। মূল ঘটনা হলো দারোগা ঘোড়া নিয়ে আসামি ধরতে বেরিয়েছে। সেটি ছিল মাদী ঘোড়া, জঙ্গলে এসে বাচ্চা প্রসব করেছে। ঘোড়া এবং ঘোড়ার বাচ্চা নিয়ে বিপদে পড়েছে দারোগা। এই অবস্থায় ভিক্ষুককে পেয়ে ভিক্ষুকের কাঁধে তুলে দিল ঘোড়ার বাচ্চা। পঙ্গু ভিক্ষুক ঘোড়ার বাচ্চা কাঁধে নিয়ে হাঁটছে আর নিজের সঙ্গে বলছে-হে খোদা, আমার প্রার্থনা অনুযায়ী ঘোড়া দিয়েছ ঠিকই, কিন্তু আমি ঘোড়ায় চড়তে পারলাম না, ঘোড়া আমার ওপর চড়ল। অনুরূপ শিক্ষকতার ভুল-ভ্রান্তি, অবজ্ঞা-অনীহা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের জন্যে শিক্ষা যেন বোঝা হয়ে কাঁধে না চড়ে। নান্দনিকতা ও শৈল্পিকতা যেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-শিক্ষা ব্যবস্থাকে চড়ে বেড়াতে পারে।

অর্থবহ শিক্ষা, মানবিক শিক্ষা, শৈল্পিক শিক্ষা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। সমাজের নানা অসঙ্গতি দূরীকরণে শিক্ষা অন্যতম হাতিয়ার। শুধু একটি সমাজ-দেশ-জাতি নয়, বিশ্ব মানব পরিম-লে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম শিক্ষা। শিক্ষায়, শিক্ষকতায় কোনো বৈষয়িক দিক নেই। জীবন কেবল অর্থগত, বস্তুগত বা ভোগবাদের বিষয় হতে পারে না। শিক্ষার সৌন্দর্য ও শৈল্পিক কারুকাজই পারে জীবনকে অর্থবহ করতে। শিক্ষক যদি শৈল্পিক আবহে শিক্ষার্থীকে কাছে টানতে না পারে, স্নেহ-মমতা-সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে না পারে তবে শিক্ষার আধুনিক সংজ্ঞায় সৃজনশীলতার ধারায় ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশা নিরর্থক হয়ে যাবে। একই সঙ্গে মননশীল বুদ্ধিদীপ্ত সৌন্দর্যবান মানুষ তৈরির অনন্য আন্দোলন অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হবে।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist