হাসান সাইদুল

  ২২ জুন, ২০১৭

স্বাস্থ্য

প্রসাধনী নাকি বিষের প্রলেপ

প্রত্যেক মানুষই সৌন্দর্যের পূজারি। আর সৌন্দর্য রক্ষায় এবং নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে আমরা ব্যবহার করে থাকি নানা রকম প্রসাধনী। কিন্তু আজকাল প্রসাধনীতেও ভেজাল আবিষ্কার হয়েছে, যা ব্যবহার করে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষণা বলছে, বিদেশি নকল ও ভেজাল প্রসাধনীতে মিথানল-হাইড্রোকার্বন নামের জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বিষ পাওয়া গেছে। দেশের নামি-দামি শহর এমনকি গ্রামগঞ্জেও বিদেশি নামি-দামি ব্র্যান্ডের নকল ও ভেজাল প্রসাধনী আটকের পর র‌্যাবের ফরেনসিক ল্যাবে ৪৮টি নমুনা রাসায়নিক পরীক্ষায় ক্ষতিকর এই বিষের সন্ধান মিলেছে। এর ফলে জনস্বাস্থ্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে বলে দাবি করেন বিশিষ্টজনরা। হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেছেন, মিথানল বিষক্রিয়া তৈরি করে। এটি সুগন্ধিযুক্ত পণ্যে ব্যবহার করলে জনস্বার্থে সতর্ক বার্তা দিতে হয়। তবে নকল ও ভেজাল প্রসাধনী সামগ্রীতে মিথানলের ব্যবহার বৈজ্ঞানিকভাবে ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রসাধনে নানা ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিভিন্ন ধরনের মেকআপ, ময়েশ্চারাইজার, সাবান, শ্যাম্পু, ফেসপাউডার, লিপস্টিক, নেইল পলিশ ইত্যাদি প্রসাধনসামগ্রীতে প্যারাবেন নামক এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার হয়ে থাকে। মিথাইল প্যারাবেন, বিউটেল প্যারাবেন, প্রপেল প্যারাবেন, ইসোবিউটেল প্যারাবেন, ইথ্যাইল প্যারাবেন ইত্যাদি নামে পাওয়া যায় এই রাসায়নিক। বিষাক্ত এই রাসায়নিকের যথেষ্ট ব্যবহার রয়েছে বলে জানা গেছে। যা শরীরের হরমোন নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এর অধিক ব্যবহারে হতে পারে স্তন ক্যানসার। প্যারাবেন সহজে ত্বকের ভেতরে প্রবেশ করে মানব দেহের অন্তঃক্ষরা (এন্ড্রোক্রিন) হরমোন ফাংশনকে সরাসরি বাধাগ্রস্ত করে। প্রাথমিকভাবে এটি নারীদের হরমোন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে দেয়। অপর এক গবেষণায়, মানুষের স্তন ক্যানসার টিস্যুতে এই রাসায়নিক শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া এটির ব্যবহারে পুরুষ প্রজনন ব্যবস্থা ব্যাহত করতে পারে। এমনকি ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ক্রিম এবং সেভিং ফোম জাতীয় কসমেটিকসে ডিইএ ব্যবহত হয়। যা শরীরে ক্যানসার সৃষ্টিকারী কোষ গঠনে সহায়ক। মূলত এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক ময়েশ্চারাইজার ও সানস্ক্রিনে ব্যবহত হয়। কিছুক্ষেত্রে সাবান, ক্লিনসার ও শ্যাম্পুতেও ব্যবহত হয়। ডিইএ এবং তার যৌগসমূহ ত্বক এবং চোখের জ্বালা সৃষ্টি করে। ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এসব রাসায়নিক পদার্থের উচ্চ মাত্রায় ব্যবহার লিভার ক্যানসার এবং ত্বক ও থাইরয়েড পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

নখের প্রসাধনীতে দ্রাবক (পলিশ) হিসেবে এবং কিছু চুল স্প্রে করতে ডাইবিউটাইল থ্যালেট ব্যবহত হয়। নেইল পলিশকে দৃঢ় করতে মূলত এটির ব্যবহার করা হয়। ডাইবিউটাইল থ্যালেট চামড়ার মাধ্যমে শোষিত হয়। এটা জিনগত মিউট্যাশন ঘটাতে অন্যান্য রাসায়নিকসমূহকে সহায়তা করে। ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, টেস্টিস এবং প্রস্টেট পরিবর্তন এবং শুক্রাণু হ্রাস করার ক্ষেত্রে এটি ভূমিকা রাখে। ময়েশ্চারাইজার, মেকআপ ইত্যাদিতে এই রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক দুটি ঘনিষ্ঠভাবে লিপস্টিক এবং ময়েশ্চারাইজার, অন্যান্য প্রসাধনীর প্রিজারভেটিভ হিসেবেও ব্যবহত হয়। এগুলো ব্যবহারে চামড়ায় অ্যালার্জিক রি-অ্যাকশন তৈরি করে। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ এই রাসায়নিককে ক্যানসারের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ইউরোপীয় কমিশনের মতে, এটি এন্ড্রোক্রিন হরমোন ফাংশনে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত রয়েছে। পরীক্ষায় দেখা দেছে, রাসায়নিক দুটির কারণে থাইরয়েড ও কিডনিতে সমস্যা এবং ফুসফুসের ফাংশন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চমাত্রায় এর ব্যবহারের ফলে নারী-পুরুষের প্রজনন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চুলের রং হিসেবে কোল টার ডাই ব্যবহার হয়ে থাকে। পিট কয়লা বা আলকাতরা থেকে এটি সংগ্রহ করা হয়। এটি মূলত পিনোলিনি ডাই অ্যামোনিয়া। যা মানব দেহে ক্যানসার সৃষ্টি করতে সক্ষম। মনোরম সুগন্ধি উৎপাদনে ব্যবহত হয়ে থাকে কৃত্রিম ফ্রাগ্রানেস এবং পারফিউম। বিভিন্ন প্রসাধন, ডিউডোরেন্ট, বডি স্প্রে এবং পারফিউম উৎপাদনে প্রায় তিন হাজার রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব রাসায়নিক উপাদানগুলো অ্যালার্জি, মাইগ্রেইনস এবং হাঁপানি সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া ত্বকে চুলকানি, চোখ জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে। যুক্তরাজ্যের গবেষকদের এক রিপোর্টে দেখা যায় যে, অ্যালার্জি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর একটি বড় অংশের অসুস্থতার মূল কারণ সুগন্ধি।

কন্ডিশনার, ময়েশ্চারাইজার, ডিউডরেন্ট ইত্যাদিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহত হয় পলি ইথিলিন গ্লাইকল (পিইজি)। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মতে, এটি ক্যানসার সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। খনিজ তেল বা পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যাপক ব্যবহত একটি পণ্য। দেশের সব স্তরের মানুষ এটি ব্যবহার করে থাকে। স্কিন কেয়ার পণ্য, লিপবাম, লিপস্টিক ইত্যাদি তৈরিতে প্রধান উপাদান পেট্রোলিয়াম জেলি। সাধারণত ত্বকের আর্দ্রতা রক্ষা করতে এটি ব্যবহার হয়ে থাকে। এর ব্যবহারে ত্বকে অ্যালার্জির সৃষ্টি হয়। এমনকি ক্যানসারও হতে পারে। সাবান, শ্যাম্পুু, ফোম, ডিটারজেন্ট ইত্যাদিতে ফেনা সৃষ্টি করতে এগুলো ব্যবহার করা হয়। এর অধিক ব্যবহারে চোখের ক্ষতি, বিষণœতা, শ্বাসনালির ক্ষতি, ডায়রিয়া এবং তীব্র চামড়া জ্বালা হতে পারে। এটি ইমিউন সিস্টেমের ক্ষতি করতে পারে- যা পরবর্তীতে হার্ট, লিভার, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের দারুণ ক্ষতি করে।

সাম্প্রতিক আমাদের বাজারে যেসব কসমেটিক বা প্রসাধনী পাওয়া যাচ্ছে, তা বাইরে থেকে মনে হয় আমদানি করা বিদেশি পণ্য। এসব পণ্যে লেখাও থাকে ইংল্যান্ড, ইউএই, জাপান অথবা অন্যান্য উন্নত দেশের নাম। এসব পণ্যের মোড়ক দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এটা আসলে স্থানীয় পণ্য। আসলে পণ্যের মোড়কে যেটা থাকে সেটা স্থানীয়ভাবে রিফিল করা। এসব পণ্যের কৌটা বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এমনকি প্যাকেজিংটাও বাইরে থেকে আনা হয়। এখানে শুধু ছোট্ট একটা মেশিন দিয়ে রিফিল করা হয়। মানুষের শরীর ও স্কিনের জন্য ক্ষতিকর এমন বেশকিছু পণ্যের নমুনা র‌্যাবের পরীক্ষাগারসহ অন্যান্য জায়গায় প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে সম্প্রতি পাওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব পণ্য নকল ও ভেজাল এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) নামে একটি বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশের নামিদামি ৩৩টি প্রসাধনী পণ্য পরীক্ষা করে সবটিতে ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব পেয়েছে। হেয়ার জেল, বেবি লোশন, বিউটি ক্রিমসহ বিভিন্ন প্রসাধনীতে আর্সেনিকসহ বিভিন্ন রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বেসরকারি সংস্থা এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলছেন, ফেসওয়াশ, হারবাল ফেসপ্যাক, বেবি লোশন, রং ফর্সাকারী ক্রিমেই ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব বেশি, যার মধ্যে বিষাক্ত ভারী ধাতু এবং ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক রয়েছে। একেবারে জনপ্রিয় প্রসাধনীগুলোই পরীক্ষা করে পাওয়া যায়, প্রতিটিতেই অন্তত একটি ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব রয়েছে। এর সবটির মধ্যেই বিষাক্ত ভারী ধাতু এবং ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক রয়েছে। নামিদামি পণ্যগুলোর ক্ষেত্রেই যদি এই অবস্থা হয়, কম দামি অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে আমাদের শারীরিক পরিচর্যার জন্য দৈনিক কোনো না কোনো ক্রিম বা সাবান ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু খাদ্য ভেজালের সঙ্গে যদি ব্যবহৃত দ্রব্যাদিতেও ভেজাল ও বিষাক্ত পদার্থ মিশ্রণ থাকে, তবে জীবন অবশ্যই অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। এসবের তদারকের দায়িত্ব সাধারণ মানুষের নয়, খোদ সরকার ও স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়েরই।

আজকাল কোনটা আসল প্রসাধনী আর কোনটা নকল তা বোঝাই মুশকিল। নকল কসমেটিক চিনবেন কীভাবে? তার সহজ উপায় হলো, কসমেটিক ব্র্যান্ডের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে যে পণ্যটি কিনবেন তার আসল ‘চেহারাটা’ দেখে নিন। প্রয়োজন হলে একটি ছবিও সঙ্গে রাখুন। কেনার সময় ছবির সঙ্গে ভালো করে মিলিয়ে নিন।

প্রসাধনী কেনার সময় খুব ছোট ছোট ব্যাপারগুলো খেয়াল করুন। যেমন-ফন্ট, সাইজ এবং প্যাকিজিং কালারটাও মিলিয়ে নিন। এমন কি নকল পণ্যগুলোর ওজনেও ঘাপলা থাকে। যদিও শপে দাঁড়িয়ে পণ্যের ওজন মাপা একটু অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু হাত দিয়ে ধরেও আপনি ওজনটা বুঝতে পারবেন। পণ্যের গায়ে লেখা সিরিয়াল নাম্বার, বার কোড এবং ম্যানুফ্যাকচারিং তথ্যসমূহ ভালো করে দেখে নিন। নকল পণ্য হলে বার কোডের প্রথম তিনটি ডিজিট উৎপাদনকারী দেশের কোডের সঙ্গে ম্যাচ করবে না। বেশির ভাগ সময় ফেইক কসমেটিকসের গায়ে সিরিয়াল নম্বর থাকে না। সিরিয়াল নম্বর পেয়ে থাকলেও চোখ বন্ধ করে কিনে ফেলবেন না! পণ্যটির গায়ে থাকা সিরিয়াল নম্বরের সঙ্গে প্যাকেটের সিরিয়াল নম্বর মিলিয়ে নিন। মিলে গেলে তবেই কিনুন।

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist