দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ১৬ জুন, ২০১৭

বৈশ্বিক সমস্যা

মানব পাচার

মানব পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যার নাম। বিশ্বের গরিব দেশগুলো এ সমস্যার নিত্যকার শিকার। বাংলাদেশের মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। মানব পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে এ দেশের শত শত শিশু মধ্যপ্রাচ্যে উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় জকি হতে বাধ্য হয়েছে। এদের কেউ কেউ দৌড় প্রতিযোগিতার সময় আতঙ্কে প্রাণ হারিয়েছে। ইউরোপে কর্মসংস্থানের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন জাহাজ বা নৌকাডুবিতে। সাহারা মরুভূমি পাড়ি দিতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক যুবক। মালয়েশিয়ায় চাকরির আশায় অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রলারডুবিতে কত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে তার হিসাব নেই। পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে পণবন্দি হয়ে জীবন দান কিংবা ক্রীতদাসের জীবন বরণ করার ঘটনাও কম নয়।

বাংলাদেশের প্রতি ২০ জনের অন্তত একজন এখন বিদেশে কর্মরত। বিদেশে ৮০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ ব্যাপারে জনশক্তি রফতানির সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি আদম ব্যাপারি নামের প্রতারকদের প্রতারণাও অনেক বিয়োগান্তক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। বিদেশে চাকরি দেওয়ার নাম করে লাখ লাখ টাকা নিয়ে উধাও। বিদেশে নিয়ে চাকরি না দিয়ে প্রতারণা শুধু নয়, জীবন কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও অনেক ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেলেও থেমে নেই মানব পাচারের ঘটনা। টেকনাফ থেকে ট্রলারে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ হওয়ায় রুট পরিবর্তন করেছে মানব পাচারকারীরা। এখন আকাশপথে চীন গিয়ে সেখান থেকে নৌকায় করে সাগরপথে মানব পাচার করা হচ্ছে। আকাশপথে ইন্দোনেশিয়ায় নিয়ে সেখান থেকে নৌকায় অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর ঘটনাও আগের তুলনায় বেড়েছে। লিবিয়া থেকে নৌকায় ইউরোপে যাওয়ার ঘটনা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। চলতি বছর বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি বাংলাদেশি শরণার্থী হিসেবে নৌকায় করে ইতালি গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। মানব পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। এ ঘৃণ্য অপরাধে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে-এমনটিই কাম্য।

থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে অনেকগুলো গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পরও মানব পাচার থেমে নেই। নেই পাচার বন্ধের কোনো উদ্যোগ। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূল থেকে ট্রলারে মালয়েশিয়ায় লোক পাচার করে সংঘবদ্ধ পাচারকারীরা। এদের প্রথমে নেওয়া হয় থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে। সেখান থেকে রাতের আঁধারে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়। পাচারকৃতদের একাংশকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর বদলে বিক্রি করা হয় থাইল্যান্ডের মৎস্যজীবীদের কাছে। ক্রীতদাসের জীবন তাদের নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়ায়। সংঘবদ্ধ পাচারকারীরা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাচারের শিকার লোকজনকে আটকে রেখে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ও করে থাকে। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হলে তাদের বিক্রি করে দেওয়া অথবা অনাহারে-অর্ধাহারে মেরে ফেলা হতো। থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে একের পর এক গণকবর আবিষ্কারের পর পাচারকারী চক্রের লোকজন গা-ঢাকা দিয়েছে। মালয়েশিয়া তাদের দেশে অভিবাসীদের কোনো নৌযান ভিড়তে দিচ্ছে না। ইন্দোনেশিয়াও একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে সাগরে ভাসমান বিভিন্ন ট্রলারে কয়েক হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ট্রলারগুলোতে যেমন পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই, তেমনি নেই খাদ্য ও পানীয়। গভীর সমুদ্রে বেহাল অবস্থায় এসব নৌযান যেকোনো সময় দুর্ঘটনায়ও পতিত হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ পথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সময় বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানির পরও বোধোদয় ঘটছে না। দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে পাচারকারী দলের এজেন্টরা সক্রিয় থাকায় বিদেশে কর্মসংস্থান নামের সোনার হরিণের আশায় বিভ্রান্ত হচ্ছে সরল-সোজা মানুষ। মানব পাচার একটি বিশ্বজনীন সমস্যা এবং এ সমস্যা রোধে বিশ্বসমাজ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মানব পাচারের যে অবাধ কর্মকান্ড চলছে, তা বন্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সম্মিলিত প্রয়াসের কথা ভাবতে হবে।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist