এস এম মুকুল

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

বিনিয়োগ

গ্রামকে উপেক্ষা করে উন্নয়ন অসম্ভব

শহরে ভোগ-বিলাসী জীবনযাপনের প্রধান উপাদানগুলোই আসে গ্রাম থেকে। গ্রামের মাছ, মুরগি, ডিম, হাঁস, কবুতর, গবাদি পশু, শাকসবজি, ধান-চাল থেকে শুরু করে জীবন ধারণের অন্যতম উপাদানগুলোর উৎসই হচ্ছে আমাদের গ্রাম। সেই গ্রামকে অবহেলা করে, গ্রামের উন্নয়নকে উপেক্ষা করে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের আধুনিক শহুরে সভ্যতায় পালিত পিঠা মেলা, বৈশাখী উৎসব, লোকজ উৎসব এবং মেলাগুলো কিন্তু প্রাচীন ও চিরায়ত গ্রামীণ ঐতিহ্য। দুঃখ হয়, গ্রামীণ সভ্যতা আর ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে এই শহরে যখন বাণিজ্য হয়, তখন সেই বাণিজ্যের ছিটেফোঁটাও আমাদের গ্রামবাংলার ঘরে পৌঁছে না। আমরা কথায় কথায় গ্রামকে ভালোবাসার কথা বললেও সত্যিকার অর্থে কতখানি ভালোবাসি? মুখে মুখে গ্রামীণ বা কৃষকের উন্নয়নের কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে কতখানি উন্নয়ন চাই কৃষকের। তার প্রমাণ মেলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর আচরণে। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, ডিশ বিল, ইন্টারনেট বিল, মোবাইল ফোনের বিল, নিত্য ব্যবহার্য পণ্য, চায়নিজ খাবার, বিলাসদ্রব্য, শিক্ষা আর চিকিৎসা খরচ বাড়লে সবই যেন আমাদের সয়ে যায়। শুধু কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ধান, চাল, সবজি, মাছ, মাংস, ফলমূলের দাম বাড়লে বাজারে, ঘরে আর আমাদের বিলাসী শহুরে মানসিকতায় আগুন জ্বলে! অথচ এই মূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। এটা কমানো গেলে কৃষকরা হয়তো ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতো না।

প্রজাদরদি জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, গ্রামীণ উন্নয়নের ওপর সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। কেননা, আমাদের শহুরে জীবনের অধিকাংশ উপভোগ্যই গ্রাম থেকে আসে। তাহলে গ্রামের কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারলেই সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন, বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য কৃষিকে বহুমুখী করার কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি কিভাবে কৃষককে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করা যায়, উৎপাদন বাড়াতে কিভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যায়, কৃষকদের সন্তানকে কী করে শিক্ষা দেওয়া যায়- এসব নিয়ে ভেবেছেন এবং কাজ করেছেন। তিনি নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন কৃষি ব্যাংক। কৃষির উন্নয়নের জন্য তিনি নিজের সন্তান, জামাতা এবং বন্ধুপুত্রকে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজে না পাঠিয়ে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। তার মানে, উচ্চশিক্ষায় উন্নত ভদ্রলোক হওয়ার চেয়ে উন্নত কৃষক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি বহু আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তবে আশার খবর হচ্ছে, কৃষিভিত্তিক শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষাকে খাটো করে দেখার দিন শেষ হয়ে গেছে আরো আগেই। এখন সময়ের প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা কৃষিভিত্তিক প্রকল্পে নিজের জীবিকার ব্যবস্থা করছে। তরুণদের মানসিকতার এই পরিবর্তন এবং তাদের মেধা, মনন ও গণজাগরণের মাধ্যমে পাল্টে দিচ্ছে আমাদের কৃষিব্যবস্থার অবকাঠামো। এখন কৃষি বলতে শুধু ধান বা ফসল ফলানোকে বোঝায় না; কৃষি এখন বহুমাত্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্র। এখনই সময় গ্রামীণ উন্নয়নকে জোরদার করে কৃষি এবং কৃষকদেরকে সামগ্রিক উন্নয়নের মূল স্রোতে নিয়ে আসা। কেননা, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকা-কে আরো প্রাণচঞ্চল করার জন্য বিনিয়োগের বিকল্প নেই। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের গ্রাম্য এলাকায় নিয়ে যেতে হবে। তাদের বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অর্থনৈতিক শুমারি-২০১৩ অনুযায়ী, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ৮০ শতাংশের বেশি অকৃষি খাতের হলেও এর ৭১ শতাংশই এখনো গ্রাম বা পল্লীনির্ভর। ৭৮ লাখ ১৮ হাজার অকৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক ইউনিট বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭১ দশমিক ৪৮ শতাংশই গ্রামভিত্তিক। তাই গ্রামের মানুষকে উপেক্ষা করে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে ক্রমাগত উপেক্ষার কারণে কৃষকদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। কৃষকরা যথাসময়ে ভর্তুকি, সার, বিষ, তেল, উন্নত বীজ, সেচ সুবিধা, ফসল ঘরে তোলার গ্যারান্টি এবং ন্যায্য মূল্য পায় না। বছরকে বছর হাওরের ফসল পানির নিচে তলিয়ে যায়। নদীর ভাঙনের ফলে ঘরবাড়ি বিলীন হয়। কৃষক এবং দেশের খাদ্যের জন্য বিরাট হুমকিÑএটা জেনেও যথাসময়ে এবং স্থায়ী পরিকল্পনায় বাঁধ নির্মাণ করা হয় না। এসব সমস্যার সমাধানে দ্রুত, স্থায়ী এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

আশার কথা হচ্ছে, গ্রামেও এখন অর্থপ্রবাহ বেড়েছে। গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট প্রভৃতি সুবিধা ক্রমেই বদলে দিচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা। বর্তমান সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের অধিকাংশই গ্রাম্য এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হলে উৎপাদন, রপ্তানি আয় এবং বহুমুখী কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর এই সুযোগের সুবাদে গ্রামীণ উন্নয়নে প্রভাব পড়বে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, ১০ বছরের ব্যবধানে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গ্রামের জনবলও বেড়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় রূপান্তর ঘটেছে অর্থ সরবরাহের ক্ষেত্রে। আগে গ্রাম থেকে অর্থ শহরে চলে যাওয়ার যে রীতি প্রচলিত ছিল, এখন হচ্ছে তার উল্টোটা। এখন বিত্তবানরা শহর থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ পাঠাচ্ছে গ্রামে। শহরের মানুষেরা আরো সুখে থাকার জন্য নিজ গ্রামে মাছ চাষ, সবজি চাষ, ফলবাগান, গবাদি পশুর খামার, এমনকি ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পও স্থাপন করছে। গ্রামমুখী এসব কর্মকা-ের ফলে গ্রামেও স্থানীয় অনেক পণ্য তৈরি হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন গ্রামীণ অর্থনীতিতে পেশা বাছাইয়ে বহুমুখিতা সৃষ্টি হয়েছে।

ভারতের ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২১.৪৭ লাখ কোটি রুপি ব্যয় ধরে কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে। আমাদের দেশেও জাতীয় বাজেটে গ্রামীণ উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা আবশ্যক। কেননা, গ্রামের উন্নয়নের জন্য দরকার গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থান। আমাদের একেকটি গ্রাম একেকটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ শহরবাসী। অবশিষ্ট ৬৯ শতাংশ এখনো গ্রামে বাস করে। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে বৈষম্য অনেক। আমাদের দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় শহরকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেভাবে গ্রামকে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। গ্রামকে উপেক্ষা করে কখনোই দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়Ñএই চিরন্তন সত্যকে এড়িয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না।

২০০৩ সালের শুমারি অনুযায়ী, শহরে ৫১ দশমিক ৬৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে এবং গ্রামে ৪৮ দশমিক ৩১ ভাগ প্রতিষ্ঠানে অর্থনৈতিক কর্মকা- চলত। ১০ বছর পর ২০১৩ সালে গ্রামে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ৫৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০০৩ সালে গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ৩৫৮টি। ১০ বছর পর এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯১ হাজার ৯৭৮-তে। তার মানে, গ্রামীণ অর্থপ্রবাহ ও উন্নয়ন অগ্রসর হচ্ছে। এর পরও সরকারের আরো সুনজর প্রয়োজন। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পাশাপাশি বিনা মূল্যে প্রদানকৃত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবাও বড় অবদান রাখছে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিপুল সংখ্যক যুবক থাকা উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বিরাট সুযোগ। বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী যুবকের সংখ্যা প্রায় ৯ কোটি। যুব সমাজই উন্নয়নের চাবিকাঠি। আমাদের যুব সমাজের অধিকাংশের অবস্থান গ্রামাঞ্চলে। তাদের মেধা ও শ্রমকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলেই খুলে যাবে উন্নয়নের দুয়ার। এখন প্রয়োজন, তারা যেন কাজের খোঁজে শহরমুখী না হয়ে, জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে বিদেশে না গিয়ে নিজের গ্রামে থেকে কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক উৎপাদন তৎপরতায় জড়িত হয়। তারা যেন সফল আবাদের পাশাপাশি এখন হাস-মুরগি, গরু মোটাতাজাকরণ, মৎস্য এবং দুগ্ধ খামারের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর এজন্য তাদের সামনে এসব ক্ষেত্রের সাফল্যের সম্ভাবনাগুলোর তথ্য তুলে ধরতে হবে। তাহলে তরুণরা চাকরিনির্ভর না হয়ে আত্মকর্মসংস্থান-মূলক প্রকল্প স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠবে। তরুণদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের তিন তরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাবা ইসলাম, সিফাত সারোয়ার ও সাজ্জাদুর রহমান মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত এইচএসবিসি ইয়াং এন্ট্রিপ্রেনার অ্যাওয়ার্ড-২০১০-এর দ্বিতীয় সেরার পুরস্কার অর্জন করেন। তাদের বিষয় ছিলÑইউরিয়া সারের অপচয় রোধে কাঁচাবাজারের পরিত্যক্ত শাক-সবজি সীমিত অক্সিজেনে পুড়িয়ে পরিবেশবান্ধব সার ‘বায়োচার’ তৈরি করা। তরুণ প্রজন্মের এসব উদ্ভাবনী ভাবনাকে দ্রুত কার্যকর করা দরকার। গ্রাম্য এলাকায়, অন্তত উপজেলা পর্যায়ে শিল্প-কারখানা-গার্মেন্ট-কুটিরশিল্প স্থাপনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে জমি, ব্যাংক লোন, পরামর্শ এবং প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়লেই ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এলাকায় কাজ পেলে মানুষ আর শহরমুখী হবে না। শহরে মানুষের অযাচিত চাপ কমবে।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist