কামরুল ইসলাম

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

পর্যালোচনা

যুক্তরাষ্ট্র বনাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর্মকা- বিকৃত মানসিকতার পরিচয় বহন করে কি না তা গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং সেসব বিষয় নিয়ে বলতেও আগ্রহী নই। কারো অপ্রকৃতিস্থতা প্রমাণ করার কাজ রোগ নির্ণয়কারীদের।

সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিনকে নিয়ে ফের হইচই শুরু হয়েছে। তার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক তদন্ত করে দেখার দাবি উঠেছে আবার। এতে যোগ দিয়েছেন রিপাবলিকান দলের কয়েক নেতৃস্থানীয় সদস্য। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করার অভিযোগের মুখে পদত্যাগ করেন ফ্লিন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বইছে ঝড়। কংগ্রেসের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দলের সদস্যরা হোয়াইট হাউসের অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাশিয়া কানেকশন নিয়ে তদন্তের দাবি তুলেছেন।

এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এলিট শাসক থেকে আমেরিকার রাজনৈতিক জগতে বিক্ষুব্ধ অবস্থা বিরাজ করছে। দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে পুঁজিবাদী এ রাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস, সিআইএ, এনএসএ, এফবিআই ও পেন্টাগন। সম্পৃক্ত হয়েছে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দুই দলেরই নেতৃস্থানীয় সদস্য। দ্বন্দ্বের মূলে আছে পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক গোয়েন্দা ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিভাজিত অবস্থান। রাশিয়ার বিরুদ্ধে জোরালো আগ্রাসী লাইন গ্রহণে ট্রাম্প প্রশাসনের অনীহা।

শাসক শ্রেণির মধ্যে যারা ট্রাম্পবিরোধী তারা পররাষ্ট্রনীতিতে রাশিয়াকে অবশ্যই টার্গেট হিসেবে রাখার পক্ষে। লক্ষ্য, পুতিন শাসন দুর্বল ও ভেঙে ফেলা। যুক্তরাষ্ট্র চায় তার অবক্ষয়িত বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা ও অবস্থান চাঙ্গা করতে, আরো উপরে তুলতে। তার লক্ষ্য অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারের পথে অন্তরায় ক্রমবর্ধমান শক্তি চীন এবং বিশেষভাবে গণ্য রাশিয়াকে দূর করা। দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তির দেশ রাশিয়াকে অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় পিছনে ফেলা। তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ ইউরেশীয় ভূখ-ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভীষণ বিপদের মুখে। ট্রাম্প প্রশাসনের হিং¯্র চরিত্র গোয়েন্দা সংস্থার ভেতর তাদের প্রতিপক্ষকে প্রতিক্রিয়াশীলই করে রাখবে। আবার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে দেশের বাইরে আরো বড় আকারে ও বিস্তৃত পরিসরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাধানোর এবং ভেতরে সাধারণ মানুষদের ওপর আঘাত হানার। চক্রান্ত চলছে বিপুল পরিমাণে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াতে সামাজিক কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ ও অবসর ভাতা থেকে মোটা টাকা কর্তনের।

গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আক্রমণ, অনাকাক্সিক্ষত নির্বাহী আদেশে মুসলিম-প্রধান দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে অভিবাসী যুবক তরুণসহ লাখ লাখ মানুষ নতুন সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বিশ্বজুড়ে এ অবস্থা। এ বিক্ষোভ ছিল নজিরবিহীন। কিন্তু এই বিশাল সামাজিক আন্দোলনে সাধারণ মানুষের জন্য পরিষ্কার কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই, নেই কোনো সঠিক নেতৃত্ব। ফলে নেতৃত্বপ্রদানকারীরা, যে নামেই মাঠে নামুক, আন্দোলনকে হাইজ্যাক করে নিয়েছে তারা। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রোপাগান্ডা নতুন প্রশাসনের চেয়ে কম প্রতিক্রিয়াশীল নয়। ডেমোক্র্যাটরাও যুদ্ধোন্মাদ। বিশ্বজুড়ে সম্ভাব্যরূপে বিপর্যয় তৈরির মনোভাবে আচ্ছন্ন ডেমক্র্যাটিক পার্টির অন্তর। নির্বাচনের শেষ মাসজুড়ে হিলারি বারবার ট্রাম্পকে আক্রমণ করেছেন রাশিয়ার সাগরেদ বলে। নিজেকে জাহির করেছেন মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের যথোপযুক্ত রক্ষক হিসেবে। আন্দোলনের নেতারা যারাই হোন না কেন, তারা করপোরেট ও অতিধনিক পুঁজির প্রতিনিধিত্ব করে। সেবা করে ধনকুবের শাসকদের। কাজেই তারা আন্দোলনকে ঘুরিয়ে নিয়ে শেষমেশ কাজে লাগাবে যুদ্ধ-পরিকল্পনায়। ট্রাম্পকে রাশিয়ার সাগরেদ বলার সুযোগ পেয়ে প্রকারান্তরে যুদ্ধের ব্যাটারিতেই শক্তি সঞ্চারিত করছে তারা। এখন আর বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না কেন ফ্লিনকে কেন্দ্র করে এত হই হই কা- রই রই ব্যাপারের সৃষ্টি। কারণ ওই আন্দোলনমুখী মানুষদের মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া।

ডেমোক্র্যাটরা আশা করছে, এক ঢিলে দুই পাখি মারার। তারা চাচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা জিইয়ে রাখতে। সাধারণ মানুষ যাতে দাবিদাওয়া আদায়ে মাথাচাড়া দিতে না পারে, সে চিন্তাও তাদের মাথায় আছে। তারা ট্রাম্প সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে তাদের দিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে ‘সংশোধনী’ আনাতে যাতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রচার-প্রোপাগান্ডা, যা শুরু করেছিল ওবামাধীন সিআইএ। ফ্লিন-নাটকের হইচইয়ের নিচে চাপা পড়ে যায় মুসলমানদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, শরণার্থীদের ওপর হামলা, নতুন প্রশাসনের চরম দক্ষিণপন্থী চরিত্র ও ষড়যন্ত্রবিরোধী জনমত এবং আলোচনা। এটাই প্রথম নয়। মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের পতনের পর ২০১৩ সালে মিসরে দক্ষিণপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে তাদের সেখানকার অনুগত সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা ওই আন্দোলনকে কব্জা করে পুনরায় সামরিক স্বৈরাচারকে প্রতিষ্ঠিত করে। দেশে দেশে আন্দোলনকারীদের মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে এরা খুবই দক্ষ। এক্ষেত্রে খুব নাম(!) আছে তাদের। এ কাজে গণবিরোধীদের সব অংশই একাট্টা। জনগণের দাবিদাওয়া আদায়ের পথটাই পালটে দিয়ে তাদের বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ কর। তাই বলা যায়, গণবিরোধী তৎপরতায় অত্যাচারীদের সব অংশই একাট্টা।

পৃথিবীর ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষ যুদ্ধ চায় না। বাস্তবত রাশিয়া বা চীনের এই সাধারণের সঙ্গে অন্য সাধারণের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক আগ্রাসন বৃদ্ধির প্রতিও কোনো সমর্থন নেই। তারা সামাজিক বৈষম্য ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আঘাত হানার বিরোধিতা এবং শান্তি ও নিরাপত্তা আশা করে। কিন্তু তাদের এ আশা কোনো দিন পূর্ণ হয়নি। পূর্ণ হলেও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। তাই, সময় এসেছে নতুন করে নতুন চিন্তা-চেতনার সমন্বয় ঘটানোর।

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist