reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৫ আগস্ট, ২০২০

মতামত

চাল আমদানিতে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন কৃষক

নিতাই চন্দ্র রায়

চাল বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। সাধারণ মানুষ তাদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করেন পণ্যটি ক্রয়ে। দাম বাড়লে সংকটে পড়েন স্বল্প আয়ের লোকজন। চালের দামের সঙ্গে এ দেশের মানুষের রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাজারে চালের দাম সামান্য বৃদ্ধি পেলেই পত্রপত্রিকায় হইচই পড়ে যায়। সরকারের বাজার মনিটরিংয়ের কর্মকা- বেড়ে যায়। কিন্তু কৃষক যখন ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলতে পারেন না, তার খবর সেভাবে প্রচারিত হয় না। সরকারও বিষয়টি গুরুত্ব দেয় না। সবাই ভোক্তার স্বার্থ দেখেন। কম দামে চাল চান। কেউ ভাবেন না, কৃষক কত দিন লোকসান দিয়ে এভাবে ধান বিক্রি করে সারা দেশের মানুষের অন্ন জোগাবে?

২০১৭ সালে হাওরে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। চালের দাম বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি কেজি ৫০ টাকায়। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার চালের আমদানি শুল্ক কমিয়ে তখন শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসে। সরকারের হিসাবে সে বছর হাওরের বন্যায় সর্বোচ্চ ১০ লাখ টন কম চাল উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে শূন্য শুল্কের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বেসরকারি আমদানিকারকরা ২০১৭-১৮ সালে ৬০ লাখ টন চাল আমদানি করে কৃষকের বারোটা বাজান। এতে ধান ও চালের দাম একবারে কমে যায়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এই পরিস্থিতিতে সরকার এ বছর কৃষকের ন্যায্যমূল্য দিতে সাড়ে ১৯ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু মার্চ থেকে করোনা-সংক্রমণ শুরু হওয়ায় চালের দাম বেড়ে যায়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চালের দাম গত এক মাসে কেজিতে দুই টাকা বেড়েছে। বাজারে মোটা চাল বর্তমানে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক মাসে মাঝারি মানের চালের দামও বেড়েছে কেজিতে এক টাকা।

করোনার জন্য দুই মাস ধরে ত্রাণ দেওয়ায় সরকারি খাদ্য গুদামের মজুদ ক্রমেই কমে আসছে। বন্যার কারণে সামনে তা আরো কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চালকল মালিকরাও চুক্তি অনুয়ায়ী সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করছেন না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবার সরকার চাল আমদানির দিকে ঝুঁকছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে চালের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। বর্তমানে চালের আমদানি শুল্ক ৬৫ শতাংশ। এদিকে চালকল মালিকরা সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ না করলেও সরকারের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলছেন, শুল্ক কমিয়ে দিলে ২০১৭-১৮ সালের মতো নিয়ন্ত্রণহীন আমদানি হবে। প্রয়োজনের বেশি চাল আমদানি হয়ে ধান-চালের দাম কমে যাবে। কৃষক এবং চালকল মালিক উভয়ে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা সরকারিভাবে সীমিত পরিমাণে চাল আমদানির পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন।

বোরোর ফলন এবার কৃষকের প্রত্যাশার চেয়ে ৭ শতাংশ কম হয়েছে। উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১৩ শতাংশ। কৃষককে কৃষি শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি দিতে হয়েছে ১৭ শতাংশ। এসব কারণে কৃষকের প্রত্যাশিত লাভের পরিমাণ কমে গেছে ৪০ শতাংশ, যার আর্থিক মূল্য ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। ‘বোরো চাষিদের ওপর করোনার প্রভাব’ শীর্ষক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের এক গবেষণায় এসব তথ্য ওঠে এসেছে। সম্প্রতি (৬.৭.২০২০) ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) থেকে এক অনলাইন সভায় গবেষণার এসব ফলাফল প্রকাশ করা হয়। গবেষণায় সারা দেশের ২ হাজার ৮৩৪ জন বোরো চাষির নিকট থেকে ফোনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। করোনাকালে কৃষি শ্রমিক সংকট, পণ্য পরিবহন ও আর্থিক টানাপড়েনের মতো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হন কৃষক। গবেষণায় অংশ নেওয়া কৃষকরা গড়ে ৭৬৫ টাকা মণ দরে বোরো ধান বিক্রি করেন এবং শতকরা ৯৯ জন কৃষককেই তাদের ধান সরকার নির্ধারিত ১ হাজার ৪০ টাকা মণের চেয়ে কম দরে বিক্রি করতে হয়েছে। ৮০ শতাংশ কৃষক, যারা ৯০০ টাকার বেশিতে প্রতি মণ ধান বিক্রি করতে পেরেছেন, তারা দাম নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। গবেষণার সুপারিশে কৃষিতে সরকারি ঋণের সঠিক সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

দেশে চালের চাহিদা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে উৎপাদনের প্রকৃত পরিমাণ, জনসংখ্যা এবং জনপ্রতি চাল ব্যবহারের পরিমাণ নিয়েও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বার্ষিক জনপ্রতি চালের ব্যবহার ১৫২ কেজি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১৯ সালে দেশে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখ। এর সঙ্গে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বিদেশিদের সংখ্যা যোগ করলে মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ কোটি। সেই হিসাবে দেশে মোট বার্ষিক চালের চাহিদা ২ কোটি ৫৮ লাখ ৪০ হাজার টন। চালকল মালিকদের মতে, দেশে এই মুহূর্তে বিদেশিসহ জনসংখ্যা ২০ কোটি। সে হিসাবে বছরে চালের প্রয়োজন ৩ কোটি ৪ লাখ টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, এবার বোরো চাল উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ২ লাখ টন, আমন মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টন এবং আউশ চাল উৎপাদন হয়েছিল ৩০ লাখ ১২ হাজার টন। সে হিসাবে দেশে এ বছর চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮২ লাখ টন, যা চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। চাহিদা ৩ কোটি ৪ লাখ টন ধরলেও দেশে ৭৮ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এ অবস্থায় বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হলে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মুহূর্তে চাল আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। বাজারে যাতে কেউ সিন্ডিকেট করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সরকারকে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, চাল রফতানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, যাতে কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পান। কৃষক তার ধানের ন্যায্য দাম পেয়েছেন। কিন্তু বাজারে চালের দাম অস্থিতিশীল করে রেখেছে একটি চক্র। সরকারি গুদামে এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার সিকি ভাগ চালও সরবরাহ করেনি চালকল মালিকরা। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি গুদামে চাল কিনতে আমদানি করা চালের শুল্ক কমানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে কৃষকের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে মিল মালিকরা দাম কমালে এবং সরকারি গুদামে চুক্তি মোতাবেক চাল সরবরাহ করলে আমদানির প্রয়োজন হবে না। চালকল মালিকদের বক্তব্য হলো সরকার ধানের দাম যে হারে নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে অনুযায়ী চালের দাম দিচ্ছে না। সরকার নির্ধারিত ৩৬ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করলে মিলারদের কেজি প্রতি চার টাকা লোকসান হবে।

গত ৩০ এপ্রিল, খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন ধান-চাল কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর মধ্যে কৃষকের কাছ থেকে প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে ৮ লাখ টন ধান, চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকদের নিকট থেকে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল। ২৬ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে বোরো চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে, যা চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ৪ জুলাইয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই মাসে সারা দেশে ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৭০ হাজার ৬৬১ টন। আর সিদ্ধ চাল ২ লাখ ৬১ হাজার ৩০২ টন এবং আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে ৩৩ হাজার ৬৭৪ টন। খোলা বাজারেও সরকার নির্ধারিত মূল্য কাছাকাছি হওয়ায় কৃষক ও চালকল মালিকরা সরকারি গুদামে ধান-চাল সরবরাহ করছেন না। ফলে সরকারি সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে খাদ্যমন্ত্রী চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমানে সরকারি গুদামে ৯ লাখ ৫ হাজার টন চাল মজুদ রয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। বর্তমানে থাইল্যান্ড, ভারত ও ভিয়েতনামে প্রতি টন চালের মূল্য ৩৭৫ থেকে ৪৭৫ ডলার। সে হিসাবে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৩২ থেকে ৪১ টাকা।

আমাদের কথা বাজার নিয়ন্ত্রণ, মজুদ বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার চালের আমদানি শুল্ক হ্রাস করতে পারে। কিন্তু শুল্ক হ্রাসের সেই সুযোগ নিয়ে বেসরকারি আমদানিকারকরা যাতে দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণ চাল আমদানি করে কৃষকদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে, কৃষক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া সিন্ডিকেট গঠনের মাধ্যমে যাতে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল করোনাকালীন সময়ে চালের মূল্য বৃদ্ধি করে ভোক্তা সাধারণের দুর্ভোগ বাড়াতে না পারে সেজন্য নিয়মিত বাজার মূল্যায়ন ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষক ও চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকরা কেন সরকারি গুদামে চাল সলবরাহ করছেন না, তার কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে বন্যা পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনকালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ধান চাষিদের ধানের চারা, সার ও নগদ প্রণোদনা প্রদান করে আমন মৌসুমে চাল উৎপাদনের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।

লেখক : কৃষিবিদ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close