জান্নাতুল মাওয়া নাজ

  ১৬ মে, ২০২০

দৃষ্টিপাত

বাড়ছে মানবিক বিপর্যয়

বিশ্বের নতুন উপদ্রব করোনাভাইরাস যা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। করোনার আগ্রাসী ভয়াবহতায় জ্বলছে সারা পৃথিবী। মানুষ আজ শঙ্কিত। করোনাভাইরাস শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে অর্থনীতির চাকা স্তব্ধ। ফলে কমে যেতে পারে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও। যার ফলে চাকরি হারিয়ে মানুষ হতে পারে কর্মহীন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই করোনাভাইরাসের কারণে দেশে দেশে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। একইভাবে করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও মানবিক সংকটের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

করোনাভাইরাস আতঙ্কে একের পর এক নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বড় বড় সব বৈশ্বিক আয়োজন। স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমে আসছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। ক্ষতি হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের। ফলে ধস নামছে সেসব জায়গায়। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাওয়ায় বিভিন্ন শহরে ভ্রমণে ও পরিবহন চলাচল নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রতিষেধক আবিষ্কৃত না হওয়ায় আতঙ্ক রয়েই যাচ্ছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়ছে। তবে সেটা কতটা মারাত্মক হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।

জেপি মর্গান বলছেন, পরপর আগামী দুই প্রান্তিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দেবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে। চলতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালের চেয়ে অর্ধেক কমে যাবে, জানিয়েছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান ঘটাবে, যা গোটা যুক্তরাজ্যের জিডিপির সমান। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান মন্দায় পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তার মতে, এটি অনেক ভয়ংকর এবং বিস্তৃৃত ভাইরাস হলেও বৈশ্বিক জিডিপিতে (অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ) এর স্থায়ী ক্ষতি বাছাই করা বেশ কঠিন। এই অভিঘাত পড়বে বাংলাদেশের উপরেও।

রফতানি ও রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকা শক্তি। রফতানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মতো খরচ করতে পারবেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে। কমে যাবে বেচাকেনা। চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি এরই মধ্যে বলেছে বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে ১ দশমিক ১ ভাগ কমে যেতে পারে। তাদের হিসাবে এতে মোট ৩০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হবে, ৮ লাখ ৯৪ হাজার ৯৩০ জন চাকরি হারাবে। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবিদনে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে।

করোনার প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে। শুধু চলতি বছর ৫০ ভাগ কমে অপরিশোধিত ব্রেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৩৩ ডলারে। এই পরিস্থিতি খুব সহসায় কাটবে এমন আভাস মিলছে না। কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতি ধীর হলে জ্বালানির চাহিদা এমনিতেই কমতে থাকে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোকে। বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের বড় অংশটাই আসে এখান থেকেই। অবশ্য কিছু আশা করার মতো জায়গাও রয়েছে। কারণ জ্বালানি তেলের পুরোটাই বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে কেনে। দাম কমায় এখন আমদানি খরচ আগের চেয়ে অনেক কমে যাবে। সরকার যদি বাজারে সে অনুযায়ী দাম সমন্বয় করে তাহলে শিল্পের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমবে। এতে সাধারণ মানুষও উপকৃত হতে পারেন।

ধারণা করা হচ্ছে, করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষেই সবচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে। ফলে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও আতঙ্কের কারণে বেশির ভাগ মানুষই ঘর ছেড়ে বের হচ্ছেন না। অনেক শহরে গাড়ি চলাচল ও দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। ফলে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। এতে করে শিল্পপণ্য সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে অসংখ্য পণ্যের চালান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। এছাড়া স্থানীয় লোকজন কর্মক্ষেত্রে যোগ না দেওয়া বা দিতে না পারার কারণেও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। করোনাভাইরাসে বাংলাদেশি শ্রমিক বা ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনমতো আয় করতে পারছেন না। ফলে পরিবারের কাছে আগের মতো টাকাও পাঠাতে পারছেন না। এর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরেই প্রায় ১ কোটি রিকশাচালক, দিনমজুর, কারখারা শ্রমিক, গৃহকর্মী রয়েছেন। তাদের পক্ষে কোনোভাবেই বেশি দিন কাজ না করে থাকা সম্ভব নয়। এজন্য বাংলাদেশে বড় ধরনের মানবিক সংকট তৈরি হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। স্বাস্থ্যবিমা এখানে বিলাসিতা, এবং অধিকাংশ বাড়িতে ইন্টারনেট নেই। অধিকাংশ কাজই বাড়িতে বসে করা সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের ১৫ শতাংশ মানুষ দৈনিক ৫০০ টাকার কম আয় করেন, যা দৈনন্দিন খরচেই চলে যায়। আর গ্রামের মানুষের নির্ভরতার জায়গা বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স। বৈশ্বিক সংকটে সে নিশ্চয়তাও আর নেই। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমানের অভিমত, বাংলাদেশ তিনটি সংকট নিয়ে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে। এগুলো হলো স্বাস্থ্য সংকট, মানবিক সংকট ও অর্থনৈতিক সংকট। সরকারি হিসেবেই দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমা আর ১০ শতাংশ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। তাদের কারোরই সঞ্চয় নেই। তিনি বলেন, দেশের শ্রমবাজার ৬ কোটি ১০ লাখ মানুষের। তার মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ মাসিক বেতন পান। বাকিরা দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল। ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। বর্তমানে তাদের কোনো আয় নেই।

গবেষণায় বলা হয়েছে, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দেশে ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিন ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড় খাত-কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের পাশাপাশি এ তিন খাতের উপখাতগুলোও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রতিদিনের গড় আর্থিক মূল্য বিবেচনায় নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে।

করোনায় সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ঘরে থাকার নির্দেশনা মানছেন না অনেকেই। নিজগৃহে অবস্থান না করে বরং প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন মানুষ। কেউ পেটের দায়ে আবার কেউ কেউ বের হচ্ছেন বাজার বা আড্ডার জন্য। করোনা প্রতিরোধে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে সরকার দেশব্যাপী লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত মানুষকে ঘর থেকে বাইরে বের না হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছে। পৃথকভাবে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাকে লকডাউন করা হয়েছে। কিন্তু লকডাউন জোরদার না হওয়ায় ক্রমে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। সেই সঙ্গে বাড়ছে মানবিক-অর্থনৈতিক অনেক সমস্যা।

কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে মানবিক সংকট তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে বড় আকারে সামাজিক দূরত্ব বা মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। তবে অর্থনৈতিক ধাক্কা যা আসছে, তাতে দেশের বেশির ভাগ মানুষকে খাদ্যের সংকটে পড়তে হবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। এটি প্রশমনে অবশ্যই পথ খুঁজে বের করতে হবে। এ দেশের দরিদ্র মানুষ যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের একেক বেলা না খেয়ে কাটানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এসব লোকজন যাতে বাঁচতে পারে সেই পথ খুঁজে বের করতে হবে। তাদের যদি ঘরে বন্দি থাকতে হয়, তবে তাদের খাদ্য বা জরুরি ভিত্তিতে নগদ অর্থ সরবরাহ দরকার। এক্ষেত্রে মোবাইল মানি প্রোভাইডাররা তাদের এজেন্টদের সক্রিয় রাখতে পারে। আর আমাদের একটি আর্থিক পদ্ধতি বের করতে হবে, যাতে একেবারে গ্রামের প্রান্তিক জনের হাতে, প্রত্যেক ঘরে অর্থ পৌঁছানো যায়। তাহলে কিছুটা হলেও মানবিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close