সাধন সরকার

  ৩০ মার্চ, ২০২০

মতামত

মহামারির বিশ্বায়নে চাই বিশ্বস্ততা

এই পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য নয়, পৃথিবী নামক এই ছোট্ট গ্রহ পশু-পাখি, মাছ, কীটপতঙ্গ, সব উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের জন্যও। চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া করোনাভাইরাস এখন শুধু চীনে সীমাবদ্ধ নেই, তা বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ১৯৫টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনা আতঙ্কে এখন কাঁপছে বিশ্ব। অদৃশ্য এক জীবাণুর দাপটে থমকে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের অনেক বড় শহর। থেমে গেছে মানুষের কোলাহল, থেমে গেছে শহরের বায়ুদূষণও! মানুষে মানুষে সম্পর্কে ছেদ পড়েছে, বেড়েছে উদ্বেগ। মানুষ যেন স্বেচ্ছায় নিজেকে নির্বাসনে নিয়েছে! করোনা মহামারি সভ্যতার ওপর স্বার্থপরতার, অসামাজিকতার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে! এখন একজন আরেকজনকে ভয় পাচ্ছে! সন্দেহভাজন ব্যক্তি যেন জীবাণুবাহক। আপন হাত-মুখকেও এখন আর বিশ্বাস নেই! মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে এই অদৃশ্য জীবাণু। জীবনে নিঃসঙ্গতাকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য করেছে করোনা!

করোনা যদিও সমাজবিরোধী, মেলামেশাবিরোধী তবু এ সংকটে সহানুভূতি ও সচেতনতাই বাঁচার জন্য অন্যতম সহায়। নিজের জীবনের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে, দশের জন্য, দেশের জন্য এ মুহূর্তে সব ধরনের স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে চলতে হবে। সবার আগে বিদেশফেরতদের সম্ভাব্য সব ধরনের সতর্কতা মানতে হবে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যক্তির হাঁচি-কাশি ও হাত ধোয়ার নিয়মকানুন সবার আগে মানতে হবে। মনে রাখতে হবে, একার সুস্থতার ওপর জীবন নির্ভর করে না, সামাজিক জীব হিসেবে পরিবারের ও চারপাশের সবার সুরক্ষার ওপর সুস্থতা নির্ভর করে। এক কথায়, বিদেশফেরতদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাদের স্বেচ্ছায় ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ থাকাসহ কর্তৃপক্ষের প্রতি মুহূর্তের নির্দেশনা মেনে চলা শুধু উচিত নয়, কর্তব্য। জীবাণুবাহক সন্দেহভাজনদের ভাইরাস পরীক্ষা, শনাক্তকরণ এবং সে অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা, ভাইরাসবাহকদের কাছ থেকে রোগটি অন্যদের যাতে না ছড়ায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমাদের আশা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে। যে স্বামী অথবা ভাই বিদেশ থেকে এসেছেন পরিবারের উচিত তাকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়ে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো। এ ছাড়া করোনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে টোটকা, গুজব ও ধর্মীয় গোঁড়ামিতে কান দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। করোনাকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির ধূর্তবাজ মহলের কারণে প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। একটা গোষ্ঠী আছে, যারা দেশের সমস্যা-সংকটকে কেন্দ্র করে সুযোগ গ্রহণ করে, ফায়দা লুটে। গুজব সৃষ্টিকারী ও বাজার অস্থিতিশীলকারীদের কঠোরহস্তে স্থায়ীভাবে দমন করতে হবে। কোনো একক সংস্থা বা মন্ত্রণালয় নয়, দেশের সব সংস্থা ও বিভাগ যদি গুজব সৃষ্টিকারী ও বাজার অস্থিতিশীলকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তাহলে এর পেছনে কারা জড়িত, তা বেরিয়ে আসবে।

নিজেকে নিজে সুরক্ষা রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকেও করোনা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রাখতে হবে। চিকিৎসা সরঞ্জাম, কিট শনাক্তকরণ সরঞ্জাম, ওষুধ, কোয়ারেন্টাইনের সুস্থ পরিবেশ ইত্যাদি প্রস্তুত রাখতে হবে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পরীক্ষার ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়ানো দরকার। দরকার হলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিতে হবে। এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। সারা দেশে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগেই এখনই সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা গেলে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ওপরও জোর দিতে হবে। শুধু এখনকার জন্য নয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার সব নিয়ম-কানুন স্থায়ীভাবে মেনে চললে সবার জন্যই মঙ্গল।

পৃথিবীতে প্রাণ-প্রকৃতি ও সামগ্রিক প্রতিবেশ ব্যবস্থার ভারসাম্য বজায় না থাকলে প্রকৃতি কোনো না কোনোভাবে বিশৃঙ্খল রূপ পরিগ্রহ করে! প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান এবং ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে না পারলে তার ফল মানুষের বিপক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনায় বেশি! প্রকৃতি ও পরিবেশবিনাশী কর্মকা-ে বিভিন্ন সময় নানাবিধ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী তৈরি হয়েছে মানবিক সংকট। করোনাভাইরাসের নানামুখী প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী। যোগাযোগব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শেয়ারবাজার, পর্যটনসহ পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে হলে এখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সতর্কতাই সবচেয়ে বেশি দরকার বলে মনে হচ্ছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতার বিষয় শুধু ব্যক্তিপর্যায়ে হলে হবে না গোষ্ঠী, জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে হতে হবে। কেননা, বিশ্বায়নের এই যুগে এক অঞ্চলের পরিবেশগত সমস্যা শুধু ওই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকছে না, তা পুরো বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করছে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই বিশ্বায়ন কী দিয়েছে আমাদের? বিশ্বায়ন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রসার, বাছ-বিচারহীন উন্নতি ও ডিজিটাল সভ্যতার পেছনে বৈষম্যকে কি প্রকটভাবে বাড়িয়ে দেয়নি? বিশ্বায়ন গরিব মানুষের মৌলিক অধিকার দিতে পারেনি, পারেনি জলবায়ুসহ উন্নত বিশ্বের সৃষ্ট দুর্যোগ সামাল দিতে। এ কথা সত্য, পৃথিবীব্যাপী এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপরীতভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপাদানগুলোও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী মানুষ একে অন্যের সঙ্গে কতটা জড়িত, এক অঞ্চলের প্রকৃতি-পরিবেশ অন্য অঞ্চলের সঙ্গে কতটা সম্পর্কযুক্ত, তা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। বন্যপ্রাণী বাজারে বিক্রি হওয়া ও জীবাণু অস্ত্রের গবেষণা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে। প্রকৃতি বিনাশ করলে, প্রকৃতির প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করলে প্রকৃতিও তার প্রতিশোধ নেয়!

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব এখন নানাবিধ সংকটের সম্মুখীন। জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বরফ গলে যাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। মূলত মনুষ্যসৃষ্ট কারণে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে তাপমাত্রার ওলট-পালট আচরণে এখন প্রাণ ও প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। দূষণ সমস্যা বিশ্বব্যাপী মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নানাবিধ দূষণ আজ প্রাণিকুলের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। আমাদের এই পৃথিবী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে যেতে হলে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করেই এগিয়ে যেতে হবে।

সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা

করেই এগিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। আমাদের চারপাশের প্রকৃতি-পরিবেশের সব উপাদানই সবচেয়ে দামি সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা করতে না পারলে, সমস্যা একটার পর একটা আসতেই থাকবে!

বনভূমি, বন্যপ্রাণী, নদ-নদীসহ প্রকৃতির উপাদানসমূহের গুরুত্ব ভুলে গেলে চলবে না। যখন এক-একটা পরিবেশগত সংকট তৈরি হয় আমরা নড়েচড়ে বসি, আলোচনা হয়, কিন্তু কয়েক মাস পর সবকিছু ভুলে আবার আগের মতোই চলতে শুরু করি! নিজেদের অসচেতনতামূলক কর্মকা-ের জন্য কোনো আত্মসমালোচনাও করি না! মূলত প্রকৃতি-পরিবেশবিনাশী কর্মকা-, ভারসাম্যহীনতা ও অসচেতনতার ফলে বারবার বিভিন্ন ভাইরাস হানা দিচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমাদের সবাইকে প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা ও পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চাই সম্মিলিত প্রতিরোধ। পৃথিবীব্যাপী প্রাণ-প্রকৃতি ভারসাম্য বজায় থাকলে সমগ্র প্রাণিকুলের বসবাস আরো সুস্থ, নিরাপদ ও টেকসই হবে।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close