লায়লা মোস্তারী

  ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

নিবন্ধ

টেকসই উন্নয়নে প্লাস্টিকের ভূমিকা

বিজ্ঞানের অনবদ্য আবিষ্কারগুলোর মধ্যে প্লাস্টিক উল্লেখযোগ্য। প্লাস্টিকের আবিষ্কার ও এর বহুবিধ ব্যবহার আমাদের জীবনকে করেছে সহজতর। প্লাস্টিকের তৈরি পাত্র ও প্যাকেজিং বস্তু নিরাপদ, হালকা ও পরিষ্কার হওয়ায় আমরা সহজেই প্লাস্টিকের পাত্রে তৈরি খাবার ও পানীয় ক্রয় ও বহন করতে পারি। প্লাস্টিক এমন এক ধরনের বস্তু যা সিন্থেটিক বা আধা সিন্থটিক জৈব যৌগ দ্বারা তৈরি। ১৯৭০ সালের ১১ জুলাই ৪৩ বছর বয়সি বিজ্ঞানী লিও হেনরিক বায়েক ল্যান্ড প্রথম নতুন এ পদার্থটি আবিষ্কার করেন। তার সেই উদ্ভাবনটিই হলো প্লাস্টিক।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে প্লাস্টিক। প্লাস্টিক এমন এক ধরনের সিন্থেটিক যৌগের তৈরি যে, এটি সেলুলয়েডের চেয়েও অনেকটা ভিন্নতর। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার বহুবিধ। দৈনন্দিন জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই, যেখানে প্লাস্টিকের অবদান নেই। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সব কাজেই প্লাস্টিকের রয়েছে অসংখ্য ব্যবহার। তাছাড়া আমরা যে খাবার খাই, তা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুরু করে আমাদের আবাসস্থল, পোশাক, পরিবহন বা যোগাযোগব্যবস্থা, চিকিৎসাক্ষেত্র এমনকি বিনোদনের ক্ষেত্রেও প্লাস্টিকের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। এই যে প্লাস্টিকের বহুমুখী ব্যবহার এর অন্যতম কারণ হলোÑ প্লাস্টিক ওজনে হালকা ও মজবুত, কম খরচ, সহজে উৎপাদন করা যায় এবং সহজে বহনযোগ্য। তা ছাড়াও প্লাস্টিক অন্যান্য বস্তুর তুলনায় টেকসই। দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের বহুবিধ জিনিসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ প্লাস্টিকের বোতল, চেয়ার, টেবিল, আলমারি, বালতি, মগ, রান্নাঘরে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বিভিন্ন টিফিন বক্স ও বাস্কেট ইত্যাদি। এসব ছাড়াও দৈনন্দিন আরো অনেক জিনিসের সঙ্গেই প্লাস্টিক জড়িত। আমরা বাজার থেকে যেসব জিনিস নিয়ে আসি, সেগুলো বহন করার জন্য প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন খাবার প্যাকজিংয়ের জন্য প্লাস্টিকের ব্যবহার হয়। কারণ প্লাস্টিকের ব্যাগ সহজে বহনযোগ্য ও টেকসই।

শুধু দৈনন্দিন কাজেই নয়, শিল্প-কারখানায়ও প্লাস্টিকের রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার। ওজনে হালকা হওয়ায় এর ব্যবহার সর্বত্র। ওষুধ ও আসবাবপত্র থেকে শুরু করে অটোমোবাইল, খেলনা কিংবা শিল্পে বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। আর তা পূরণে তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক-শিল্প। প্লাস্টিক ওজনে হালকা হওয়ায় শিল্প-কারখানায় ভারী ধাতুর পরিবর্তে এটি ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। বিভিন্ন ব্যাগ তৈরিতে প্লাস্টিকের পাতলা, নমনীয় ও নন-ওভেন ফেব্রিক ব্যবহার করা হয়। যেমন : চিপস ব্যাগ, শাকসবজির ব্যাগ, আবর্জনা ব্যাগ, প্লাস্টিকের ফাইবার দিয়ে তৈরি স্টিং ব্যাগ, ভাত রান্না করার জন্য পোরস ব্যাগ, ভ্রমণ প্রসাধন ও প্লাস্টিকের ব্যাগ ইত্যাদি। ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকপণ্য ব্যবহার হচ্ছে। প্লাস্টিকপণ্য ব্যবহার করে বা প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল করে চেয়ার, টেবিল, দরজা, জানালা, বাচ্চাদের খেলনাসামগ্রী তৈরি করা হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ কোটি ৭০ লাখ ডলার আয় হয় এ খাত থেকে। আর বিগত পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত মোট রফতানির আয় হয়েছে ৪৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিকাশমান শিল্প খাত হলো এই প্লাস্টিক। প্রযুক্তি ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেশ পরিবর্তন ঘটেছে দেশের প্লাস্টিকপণ্যের। ফলে অ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিক পণ্যকে পেছনে ফেলে এসব পণ্য খুব সহজেই দেশি ও বিদেশি ক্রেতাদের মন জয় করে নিয়েছে।

সম্প্রতি চামড়ার পরিবর্তে প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে জুতা তৈরিতে। যেখানে মূল উপাদান হিসেবে রয়েছে সিন্থেটিক রাবার ও প্লাস্টিক; যা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে তা দিয়ে জুতা তৈরি করছে; যা একই সঙ্গে চাহিদা পূরণ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস করতে ভূমিকা রাখছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এসব প্লাস্টিক জুতা রফতানিতে আয় হয়েছে ১১ কোটি ৯১ লাখ ডলার; যা আগের বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। শুধু দৈনন্দিন বা শিল্প খাতেই নয়, চিকিৎসাক্ষেত্রেও রয়েছে প্লাস্টিকের ভূমিকা। যেমন : রক্ত সংগ্রহ করার ব্যাগ, বিভিন্ন ওষুধের প্যাকেট, গ্লোভস, ক্যাথেটার, টিউব, সিরিঞ্জ ইত্যাদি তৈরিতে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। কারণ উপরিউক্ত জিনিসগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার সহজতর। প্লাস্টিকপণ্যের ব্যবহার যেমন জীবনকে সহজ করেছে; তেমনি বর্জ্য প্লাস্টিক রিসাইকেল কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। প্লাস্টিক বোতল থেকে ফাইবার তৈরির ব্যবসা : পানি খাওয়ার পর যে বোতলটি বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়, সেই প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তৈরি হচ্ছে ফাইবার। এই ফাইবার দিয়ে সুতা বানিয়ে রং-বেরঙের পলেস্টার কাপড়ও তৈরি হচ্ছে। এ তুলা আবার বাংলাদেশ থেকে রফতানি করে বছরে ২০০ কোটি টাকা আয়ের পথ তৈরি হচ্ছে।

এ ছাড়া প্লাস্টিকপণ্য ব্যবহার করে রিসাইকেল পদ্ধতিতে তুলা তৈরির এই অভিনব কাজটি এখন দেশেই হচ্ছে। ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের সিংগাইরের পানিয়াশাইলে চীনা প্রযুক্তির এ কারখানা তৈরি হয়েছে। মুমাণু পলেস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ নামের এই কারখানাটিতে গত কয়েক মাসে প্রায় ৪০ টন তুলা উৎপাদন করা হয়েছে। অতিরিক্ত তুলা বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব। তাছাড়া ফেলে দেওয়া বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি প্লাস্টিক টব পাওয়া যায়; যা কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়াও কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন সার ও কীটনাশক সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিকের বিভিন্ন সামগ্রী ভূমিকা রাখে। এমনকি বিনোদনের ক্ষেত্রেও প্লাস্টিক নানাবিধ ভূমিকা রাখে। বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলনাসামগ্রী তৈরিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হয়। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের বহুবিধ ব্যবহারের ফলে পরিবেশে প্লাস্টিকের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে আর পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়েও দুশ্চিন্তায় পরিবেশবিদরা। কিন্তু সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিকর প্রভাবকে অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব এবং উক্ত প্লাস্টিক বর্জ্যকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে নতুন নতুন পণ্য তৈরি করাও সম্ভব।

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয় হলো টেকসই উন্নয়ন। আর কোনো জিনিস টেকসই ব্যাখ্যা করার জন্য কতগুলো মূল বিষয় থাকে। সেগুলো হলো সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন। টেকসই উন্নয়নের সবচেয়ে সাধারণ সংজ্ঞা হলো, টেকসই উন্নয়ন বলতে এ ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডকে বোঝায়; যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয় এবং প্রকৃতি ও আমাদের ইকোসিস্টেমের ওপর কোনো বাজে প্রভাব পড়ে না। যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিনিয়ত উৎপন্ন হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ১৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক প্রতি বছর সমুদ্রে পতিত হয়। প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। সেসব সংগ্রহ করে রিসাইকেল পদ্ধতিতে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করা যায় কিংবা সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হলে তা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত না হলেও বর্জ্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং খাত থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে আয় প্রায় ২ হাজার ৮ কোটি টাকা। প্লাস্টিকের ফেলে দেওয়া বোতলকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজ করা যায়। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা প্লাস্টিককে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যবহার করার নানা প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। এ ছাড়াও বাড়িঘর তৈরির সময় পাইপলাইন ও ইলেকট্রিক কাজে ব্যবহৃত সামগ্রীতে প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হয়, কারণ প্লাস্টিক ধাতব বস্তুর চেয়ে হ্লাকা ও টেকসই কেননা এ ক্ষেত্রে ধাতব বস্তু ব্যবহার করলে সেগুলো পানির সংস্পর্শে মরিচা ধরার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্লাস্টিক এ ক্ষেত্রে অধিক গ্রহণযোগ্য।

সর্বোপরি দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে আবাসস্থল, শিল্প-কারখানা, যোগাযোগ, চিকিৎসা সবক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের অবদান লক্ষ করা যায়। প্লাস্টিকের বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়লেও এর বহুমুখী প্রয়োজনীয় দিক সহজে উপেক্ষা করা যায় না। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন সম্ভব। এছাড়াও প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল কারখানায় কাজ করে হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপরিউক্ত বিষয়গুলো থেকে এটি স্পষ্ট যে, আমাদের জীবনের সবক্ষেত্রেই প্লাস্টিক ওতপ্রোতভাবে জড়িত; যা টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি অর্থাৎ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তাই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্লাস্টিকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : শিক্ষার্থী

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close