এস এম মুকুল

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

মুক্তমত

হাওরের সামষ্টিক উন্নয়ন জরুরি

হাওরাঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার। বাংলাদেশে দ্রুত বাড়ছে জনসংখ্যা, কিন্তু বাড়ছে না সম্পদ। এসব সমস্যা সমাধানে হাওর এলাকা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। কেবল ভূপ্রকৃতিগত বৈচিত্র্যের কারণেই নয়; অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও সম্ভাবনার বিরাট স্থানজুড়ে আছে হাওর। হাওরের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এককালে এ অঞ্চলের হাওর ও নদী থেকে তোলা উৎকৃষ্ট মুক্তা রফতানি হতো সুদূর ইউরোপে। এখানকার ঘি, মাখন, পনির ইত্যাদির খ্যাতি ছিল ভারতবর্ষজুড়ে। রফতানিও হতো এসব নানা দেশে। হাওরাঞ্চলের মিঠাপানির মাছের মতো এমন সুস্বাদু মাছ অন্য কোনো দেশে পাওয়া কঠিন। আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা ঘুচে গেছে। উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা এলাকায় এখন ফসল ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় হাওরবাসীর অকালবন্যায় ফসলহানির অনিশ্চয়তাও ঘোচানো সম্ভব হবে। সমন্বিত ও পরিকল্পিত উপায়ে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ১০ বছরে পাল্টে যাবে হাওরের চেহারা।

বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড হাওরের উন্নয়ন সম্ভাবনা বিষয়ে কাজ করছে। আমাদের রাষ্ট্রপতি হাওরবিধৌত এলাকার বরপুত্র। আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওরের উন্নয়নে বেশ আগ্রহী। তাই বলতে পারি, বহুমাত্রিক সম্ভাবনায় হাওর এখন আগ্রহের বিষয়। হাওর বিষয়ে আমার সামান্য চিন্তার আলোকে হাওর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কতিপয় প্রস্তাবনা পেশ করছিÑ ১. হাওরের ফসল রক্ষায় স্থায়ী ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

২. একফসলি নির্ভরতা থেকে হাওরের কৃষকদের ফিরিয়ে আনা জরুরি। ৩. অকালবন্যার কবল থেকে হাওরের কৃষকদের বাঁচাতে আরো কম সময়ে ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করতে হবে। ৪. কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন এবং বর্ষাকালীন ছয় মাস হাওরবাসীর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। ৫. কৃষিজ উৎপাদন বহুমুখীকরণ, সমন্বিত কৃষি, ফসলের নিবিড়তা বাড়ালে সত্যিই হাওর হয়ে উঠবে আগামী দিনের খাদ্যভান্ডার। এ ছাড়া হাওরে ধান রোপণ ও কর্তন, মাড়াই কাজে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার করলে সুফল আসবে। স্থানীয়দের ধারণা, হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুরগুলো খনন এবং অকাল বন্যারোধী বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে নির্মাণ করলে হাওরের ৮০ শতাংশের সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যায়।

উন্নয়নের প্রশ্নে হাওর এলাকায় কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। হাওর এলাকার স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা প্রসারে শিক্ষক ও চিকিৎসকদের আবাসিক ব্যবস্থা এবং বিশেষ ভাতা বরাদ্দ করার মাধ্যমে প্রণোদনা সৃষ্টি করতে হবে। হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। হাওরের ধান, মাছ, পাখি, হিজল-করচের প্রাকৃতিক বেষ্টনী সৃষ্টি করার পাশাপাশি হাওরের মাটি ও পানি নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। হাওর ট্যুরিজমকে জনপ্রিয়করণে ব্যাপক প্রচার ও প্রকাশনা দরকার। অনলাইনভিত্তিক প্রচারণার জন্য ফেসবুক, ইউটিউব এবং ওয়েবসাইট ভূমিকা রাখবে। এনিয়ে ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে মতবিনিময় করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পর্যটনকেন্দ্র গড়ে না ওঠায় হাওরে ঘুরতে আসা পর্যটকদের পড়তে হয় নানামুখী বিড়ম্বনায়। হাওরের পর্যটন খাতকে সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলে দুই ঋতুতেই (বৃহদার্থে) বিরাট অর্থকরী ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে হাওরাঞ্চল। খালিয়াজুড়ি, মোহনগঞ্জ, তেঁতুলিয়া, কিশোরগঞ্জ, নিকলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, তাহেরপুর, মধ্যনগর, ভোলাগঞ্জ, টেকেরহাট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, জামালগঞ্জÑ এসব জায়গায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মাধ্যমে পর্যটকদের থাকা, খাওয়া আর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার। এ ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত হলে হাওরাঞ্চলের পর্যটন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে। পর্যটন খাতে অনেক আয় হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

হাওরের উন্নয়ন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে মতবিনিময়, সভা, সেমিনার করে, জরিপ চালিয়ে এলাকাভিত্তিক জনশক্তি ও কর্মসংস্থান, প্রকৃতির ধরন, অবকাঠামোর বৈশিষ্ট্য নিরূপণসাপেক্ষে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে প্রশাসনিক, অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। বোর্ডের জনবল বাড়িয়ে মনিটরিং, ডেটা কালেকশন, পরিদর্শন, প্রচারণা, প্রকাশনা, গবেষণাসহ কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করা। হাওরাঞ্চলের লেখক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে হাওরের সৌন্দর্য ও সম্ভাবনাকে উপজীব্য করে লেখালেখির জন্য পরামর্শ সভা, কর্মশালা অথবা ওয়ার্কশপ করা। হাওরবিষয়ক রিপোর্টিং, প্রকাশনা ও লেখালেখিকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতি বছর সাংবাদিক ও লেখক সম্মাননা প্রদান করা। ঢাকার জাতীয় দৈনিক, অনলাইন এবং চ্যানেলের সাংবাদিকদের নিয়ে হাওর ভ্রমণের আয়োজন করা। হাওরের সার্বিক উন্নয়ন, সমস্যা, কার্যক্রম, কর্মসূচি, উদ্যোগ, আয়োজন সর্বোপরি হাওরাঞ্চলের সার্বিক তথ্য ও সংবাদ নিয়ে প্রকাশনা করা। হাওর এলাকার বিস্তীর্ণ ফসলি জমি আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে ঢুকে যায় পানি। অভিযোগ আছে, স্থানীয় প্রশাসন টাকা খেয়ে দায়সারাভাবে কোনোমতে বাঁধ করে দেন; যা ঝুঁকি এড়াতে যথেষ্ট নয়। বাঁধগুলো সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্থায়ীভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া হাওরকে প্রাকৃতিক মৎস্যভান্ডার ঘোষণা করা যেতে পারে। বর্ষায় হাওরের পানিতে দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা ব্যাপকভাবে অবমুক্ত করতে হবে। নির্দিষ্ট স্থানে ঘের করে এই পোনা বড় হওয়া পর্যন্তঅপেক্ষা করে পরে তা মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্ত করা যেতে পারে। মুক্ত জলাশয়ে ঘের পদ্ধতিতে মাছ চাষ এবং ভাসমান সবজি চাষের কথা ভাবা যেতে পারে। বর্ষাকালের আফাল বা ঢেউয়ের তান্ডব থেকে বাড়িঘর রক্ষার জন্য করচ-হিজলের ব্যারিকেড তৈরি করতে হবে। উন্মুক্ত উঁচু স্থানে হিজল, করচ ইত্যাদি গাছ লাগিয়ে জঙ্গল তৈরি করে জ্বালানি কাঠের চাহিদা মিটানো যেতে পারে। জঙ্গলে বর্ষায় মাছের উত্তম জায়গা হবে। পাখিদের অভয়াশ্রম তৈরি হবে।

রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে (বাকৃবি) জনবলসহ ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ নামে নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এখন একটি ‘হাওর বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করার দাবি জানাচ্ছি। হাওরের মাঝখান দিয়ে রাস্তা হওয়ার ফলে যোগাযোগ উন্নত হলেও হাওরের পানি, পলি ও মৎস্য অবাধে বিচরণ করতে পারছে না। এজন্য রাস্তায় ঘন ঘন কলভার্ট বসানো দরকার। এতে পলিবাহিত মাটির উর্বরতা সবদিকে ছড়াবে। মাছের বিচরণ ক্ষেত্র বাড়বে।

হাওরের করচের তেলে বায়োডিজেল উৎপাদন হতে পারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ভারতেও এ তেল কেরোসিনের পরিবর্তে কুপি জ্বালানো, রান্নাবান্না, পাম্পমেশিন চালানো, পাওয়ারট্রিলার ও ট্রাক্টর চালানো; বাস, ট্রাক ও জেনারেটর চালানো ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল জ্বালানি, লুব্রিক্যান্ট, সাবান কারখানা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পেইন্টিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। বাতের ব্যথা, চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে এর তেল ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল এবং শুকনো পাতা পোকামাকড় দমনের জন্য ব্যবহৃত হয়। করচের খৈল পোলট্রি ফিড হিসেবে ব্যবহার হয়। করচের খৈল মাটিতে প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং নেমাটোডের বিরুদ্ধে কাজ করে। এ ছাড়াও বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য খৈল গোবরের চেয়ে উত্তম উপাদান বলে অনেকের অভিমত। হাওরের কালো মাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও কাঠসহ অন্যান্য জ্বালানির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলার কারণে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শুষ্ক নদী ও হাওরের তলদেশ ৫ ফুট থেকে ১০ ফুট গভীরতায় কালো মাটি পাওয়া যায়। এ কালো মাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য এবং কাঠসহ অন্যান্য জ্বানালির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলে।

সেখানে পুরো ছয় মাসে উপযোগী সবজি ও শস্য উৎপাদনের কথা ভাবা যেতে পারে। হাওরের মাটিতে ফলন উপযোগী সরিষা, মাষকলাই, মশুরকলাই, ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে। বর্ষায় আখ চাষ, ভাসমান সবজি চাষ করা যায় কি না ভাবতে হবে। মোটকথা প্রকল্পভিত্তিক বাস্তবায়ন উদ্যোগ নিলে হাওরের প্রকৃত ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে। সবশেষে বলতে চাই, সরকার হাওরের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এখন এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে হাওরবাসীর সচেতন ভূমিকা আবশ্যক। হাওর অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হোকÑ এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close