ইয়াসমীন রীমা

  ২২ জানুয়ারি, ২০২০

মুক্তমত

শিশুর জন্য মাতৃদুগ্ধ অপরিহার্য

বর্তমানে দেশে ছয় বছরের কমবয়সি ৪৩ শতাংশ শিশু শুধু বুকের দুধ পান করে অর্থাৎ শতকরা ৫৭ ভাগ শিশু জন্মের পর মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পরবর্তী জীবনে এ মাতৃদুগ্ধবঞ্চিত শিশুরা নানা অপুষ্টিজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং একটি অংশ অকালমৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এতে সুষ্ঠু ও স্বাস্থ্যকর জাতিগঠন প্রক্রিয়া হয় বাধাগ্রস্ত। এ বাস্তবতায় সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে এ হার ৭৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সার্কভুক্ত দেশ মালদ্বীপের দিকে তাকালে দেখা যায় এক ভিন্ন চিত্র। মালদ্বীপে সামাজিক সচেতনতা এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে; যেখানে ৯৮ শতাংশ শিশুকে মায়েরা বুকের দুধ খাওয়ান।

পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ ১৫ বার মায়ের দুধ তথা শিশুদের মায়ের দুধ পানের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। সুরা আল-বাকারার ২৩৩ নম্বর আয়াতে শিশুদের বুকের দুধ প্রদানের বিষয়ে এবং কত দিন দুধ পান করাবেন- এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘মায়েরা তাদের সন্তানদের পুরো সময় পর্যন্ত দুগ্ধ পান করার ইচ্ছা রাখেন, তারা নিজেদের শিশুদের দুই বছর ধরে দুগ্ধ পান করাবে’। মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার ও নেয়ামত। মাতৃদুগ্ধ শিশুর জন্মগত অধিকারও বটে। এ অধিকার যথাযথ বাস্তবায়নে মায়েদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। এরপর রয়েছে পরিবারের অন্য সদস্যদের ভূমিকা।

বুকের দুধ খাওয়ালে শুধু শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষাই নয়, মায়ের স্বাস্থ্যেরও উপকার হয়ে থাকে। মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে প্রসবেব পরে মায়ের রক্তক্ষরণ কমে যায়। ফলে একজন মা প্রসব-পরবর্তী রক্তস্বল্পতা, স্তন এবং জরায়ুর নানাবিধ রোগ থেকে রক্ষা পায়। দেশের প্রতিটি মা যদি নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ান; তাহলে হাজারো মা স্তন এবং জরায়ুর নানা রোগ থেকে মুক্ত থাকার পাশাপাশি এসব রোগের চিকিৎসা খরচ বাবদ কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। প্রতি বছর গুঁড়ো দুধ আমদানির জন্য দেশের খরচ করতে হয় দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি। শতভাগ বুকের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করা গেলে অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম গড়ার পথ হবে সহজতর। তাই জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র খাদ্য ও পানীয় হওয়া আবশ্যক। এ ছাড়া বুকের দুধের অর্থনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। বুকের দুধ খাওয়ানোতে ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের জন্মবিরতিকরণসহ পরবর্তীতে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস পায়। ছয় মাস পর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য খাবারও শিশুকে খাওয়াতে হবে।

শিশুর জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ একমাত্র গ্রহণযোগ্য খাদ্য ও পানীয়। মায়ের দুধে আছে নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ, শারীরিক বৃদ্ধি ও বুদ্ধি বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সম্ভাব্য সব উপকরণ। শিশুকে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বুকের দুধ খাওয়ালে মা ও শিশু উপকৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপকৃত হয় শিশুর পরিবার। শিশুর ডায়রিয়া, আমাশয়, নিউমোনিয়া ও অপুষ্টি থেকে রক্ষা পায়। এ ছাড়াও ভবিষ্যতে শিশু বড় হলে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হার্টের অসুখ ইত্যাদির কম ঝুঁকির মধ্যে থাকে। গুঁড়া দুধ শিশুর নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি করে। বর্তমানে অনেক শিশু অপুষ্টির শিকার। গুঁড়ো দুধ খাওয়ানো এবং বিভিন্ন সরঞ্জামাদি, বোতল, দূষিত পানি, চুষনি বা নিপল ইত্যাদির ব্যবহার শিশুদের বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ ও অপুষ্টির জন্য দায়ী। এতে দিন দিন স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং সুস্থ জাতি গঠন হচ্ছে ব্যাহত। সফলভাবে মায়ের দুধ খাওয়াতে ১০টি শিশুবান্ধব পদক্ষেপ রয়েছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে কিছু বাস্তবায়ন করা হচ্ছে আর বাকিগুলোর ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে পরিবার ও সমাজকে। সেই ১০টি শিশুবান্ধব পদক্ষেপ হলো- ১. মায়ের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে গৃহীত নীতিমালাটি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত সবাইকে নিয়মিতভাবে জানানো। ২. স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত সব কর্মীকে এই নীতি সঠিকভাবে মেনে চলার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান। ৩. সব গর্ভবতী মাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা জানানো এবং যথাযথভাবে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য সময়মতো প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান। ৪. জন্মের আধ ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য সব মার সার্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। ৫. শিশুকে সফলভাবে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য মা ও পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান। ৬. জন্ম থেকে ৬ মাস (১৮০ দিন) পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কোনো খাবার বা পানীয় দেওয়া যাবে না (জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসার প্রয়োজন ব্যতীত)। ৭. হাসপাতালে মা ও শিশুকে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা একই সঙ্গে থাকার সুযোগ প্রদান। ৮. শিশুর চাহিদামতো মায়ের দুধ খেতে ওেদয়া। ৯. শিশুর মুখে কখনোই কোনো বোতল বা চুষনি না দেওয়া। ১০. পাড়ায় পাড়ায় শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর সহযোগী দল গঠন করা এবং মাকে হাসপাতাল বা ক্লিনিক ছেড়ে যাওয়ার সময় সেসব দলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫৪ থেকে ১৫-তে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। শিশুমৃত্যুর হার কমাতে এবং স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম তৈরিতে তাই নবজাতকের জন্য শতভাগ মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চিত করতে হবে

বিশে^র মধ্যে ফিলিপাইনসের বেশির ভাগ মানুষ বেশ রক্ষণশীল এবং ক্যাথলিক খ্রিস্টান। এ দেশের সমাজে জনসমক্ষে বুকের দুধ খাওয়ানোকে খুব ভালোভাবে দেখা হয় না। তাই অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ‘ব্রেস্ট ফিডিং ফিলিপিন্স’ পুরো দেশে একযোগে সন্তানদের জনসমক্ষে বুকের দুধ খাওয়ানোর আয়োজন করেছে। ফিলিপাইনসের ১ হাজার শহরে এই আয়োজন করেছেন উদ্যোক্তারা। গ্রুপের পরিচালক নোনা আনদায়া-ক্যাসটিলো বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, যখন কোনো নারী চলচ্চিত্রে যৌন দৃশ্যে অভিনয় করেন বা জনসমক্ষে খোলামেলা পোশাক পরেন; তখন জনগণ সেটাকে খারাপ মনে করে না। অথচ জনসমক্ষে কোনো মা যদি তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাহলে সেটা ভালো চোখে দেখেন না তারা। তিনি এ-ও জানান যে, তাদের গ্রুপের এক সদস্যকে বলা হয়েছিল তিনি যেন টয়লেটে গিয়ে তার সন্তানকে দুধ খাওয়ান। এ ধরনের আচরণ বদলাতেই তাদের এ উদ্যোগ বলে জানান ক্যাসটিলো। সম্প্রতি সালে এই গ্রুপটির আয়োজনে ১৫,২১৮ জন মা একসঙ্গে তাদের সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়ানোর বিশ্বরেকর্ড গড়ে ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ নাম লিখিয়েছেন। জানা গেছে, এবারের আয়োজনে ২১ হাজার মা অংশ নিয়েছেন। তবে গিনেস কর্তৃপক্ষ তিন সপ্তাহ পর তাদের রায় জানাবে। ১৯৮৬ সালে ফিলিপাইনসে ‘মিল্ক কোড’ নামে একটি আইন পাস হয়, যেখানে দুই বছরের কমবয়সি শিশুকে ইনফ্যান্ট ফর্মুলা খাওয়ানোর বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ২০০৯ সালে আর একটি আইন পাস হয় দেশটিতে।

যেটায় প্রাইভেট ও পাবলিক কোম্পানিগুলোতে কাজ করেন এমন মায়েরা যাতে সেসব জায়গায় অর্থাৎ তাদের কর্মক্ষেত্রে শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন, সেই ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাই আয়োজকরা এই আইনের বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close