জাকির আজাদ

  ২২ জানুয়ারি, ২০২০

বিশ্লেষণ

নিয়ন্ত্রণহীন শব্দদূষণ শিশু-স্বাস্থ্য পরিপন্থি

সুতপা বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। কুমিল্লা ফয়জুননেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। অত্যন্ত মেধাবী এই ছাত্রীর পরিবারে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যেমন কদর আছে; তেমনি স্কুলেও আছে তার বেশ সুনাম। তা ছাড়া আবৃত্তি ও ছড়াগানে দুই বছর ধরে ইন্টার-স্কুল প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে হাজারো প্রতিযোগীর মধ্য থেকে। কিন্তু এত কিছুর পরও সুতপার বাবা-মায়ের বিষণœতা থেকেই যাচ্ছে। কারণ সুতপা কানে একটু খাটো। ব্যাপারটা পারিবারিকভাবে সবাই ওয়াকিবহাল না হলেও সুতপার ডাক্তার মামা জানেন এবং তিনি এর জন্য দায়ী করেছেন শব্দদূষণকে। কারণ সুতপা যে পরিবেশে বড় হচ্ছে, তার আশপাশে শব্দদূষণ বৃদ্ধির হার সর্বাধিক। যেমন সুতপাদের বসবাসের জায়গাটি হচ্ছে কুমিল্লা মেহাজের রি-রোলিং ইন্ডাস্ট্রিজের ভেতরে। সুতপার বাবা সেই ইন্ডাস্ট্রিজের সহকারী ম্যানেজার। ইন্ডাস্ট্রিজ এলাকা মানে তো প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কল-মেশিন আর যন্ত্রপাতির ভারী শব্দ। এ অবস্থা শুধু সুতপার নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণে হাজার হাজার শিশু-কিশোর শ্রবণশক্তির দিক থেকে দুর্বল ও বধির হয়ে যাচ্ছে।

শব্দ অবাঞ্ছিত নয়, নিঃশব্দ মানুষ সভ্যতার কথা ভাবাও সম্ভব নয়। তবে শব্দ একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্তই মানুষের জন্য প্রযোজ্য। শব্দ যখন অবাঞ্ছিত, তখনই হয় কর্কশ বা সুরবর্জিত শব্দ বা Noise। আর এই কর্কশতা থেকেই দূষণ। যার প্রকোপে বর্তমান আধুনিক মানবসভ্যতা ধুঁকছে। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বস্তুর অনিয়মিত অর্যায়বৃত্ত এবং অসামঞ্জস্য কম্পনের ফলে উৎপন্ন অতি উচ্চ তীব্রতামুক্ত শ্রুতিকটু শব্দসমূহই কর্কশ শব্দ বা Noise শব্দের উৎস বলতে শহর এলাকায় গাড়ি হর্ন, মাইক, বিমান, কল-কারখানা, জেনারেটর, ঘন জনবসতি ইত্যাদি। শহরে শব্দের প্রধান উৎস বা তাদের পরিমাণ হলো মৃদু কথা বলায় ২০ থেকে ৩০ ডেসিবেল, সাধারণ কথাবার্তায় ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবেল, রাস্তার কোলাহল বা ঝগড়া-বচসা ৬০ থেকে ৮০ ডেসিবেল, মোটরের হর্নে ৯৫ ডেসিবেল, মাইকে ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল, বিমানে ১২০ ডেসিবেল, কল-কারখানায় ১০ থেকে ১১০ ডেসিবেল, হোটেল ও সিনেমা হলে ৮০ থেকে ৯৫ ডেসিবেল, উৎসব অনুষ্ঠানে ৮৫ থেকে ১০০ ডেসিবেল, মিউজিকে ১৩০ ডেসিবেল শব্দের তীব্রতা থাকে। সভ্যতার উন্নতির কল্পে শব্দ আজ এমন এক মাত্রায় এসে পৌঁছেছে যে, শহরের Silence Zone বা নীরব এলাকা বলে চিহিৃত স্থানেও শব্দমাত্রা বাঞ্ছিত নয়। হাসপাতাল অধ্যুষিত অঞ্চলকে সাধারণত চিহিৃত করা হয় Silence Zone হিসেবে। এখন সেসব এলাকাও শব্দমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে রোগীরা হাসপাতালে এসে সুস্থ হওয়ার বদলে যে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শব্দদূষণের গতি এভাবে চলতে থাকলে বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের স্বাভাবিক স্মৃতিশক্তি লোপ পাবে। কমে যাবে মানুষের আয়ুষ্কাল। হারিয়ে ফেলবে সৃজনী শক্তি।

বিশ্বের যে ২২টি দেশ প্রথম জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুসমর্থন করেছিল তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে এ সনদের বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জন্য আবশ্যকীয় হয়েছে। শিশুদের কল্যাণে যথাসম্ভব উদ্যোগ ও সহযোগিতা প্রদানে বাংলাদেশ সরকার দেশের জনগণ এবং জাতিসংঘের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর শিশু অধিকার সনদের ২৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, শিশুর সর্বোচ্চ অর্জনযোগ্য মনের স্বাস্থ্য লাভের অধিকারকে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র স্বীকার করে। শব্দদূষণের কারণে শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা তাদের সমস্যাগুলো বড়দের মতো প্রকাশ করতে পারে না। বড়রা যেমন শব্দদূষণের করণে তাদের মাথাব্যথা-৬৯ শতাংশ, বিরক্তবোধ-৬৮ শতাংশ, মেজাজ খিটখিটে ৪৯ শতাংশ অভিযোগ করছে; তেমনি শিশুদেরও এসব সমস্যা হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না শব্দদূষণের কারণে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া শব্দদূষণ মানুষের ওপর আরো যেসব প্রভাব বিস্তার করেÑ ১. কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়। ২. মানসিক অবসাদ বৃদ্ধি পায়। ৩. মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং অকারণে বিরক্তি আসে। ৪. শ্রবণেন্দ্রীয় খারাপ হয় এবং শ্রবণে বাধার সৃষ্টি করে। কান বধির হয়ে যায়। ৫. শ্বাস-প্রশ্বাসের হার অস্বাভাবিক হয়। ৬. স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। ৭. ঘুম কমে আসে। ৮. মাথা ঝিমঝিম করে, বমিভাব আসে, স্নায়ু উত্তেজিত হয়। ৯. রক্তচাপ বাড়ে। ১০. হৃৎপিন্ড ও ফুসফুসে গোলযোগ দেখা দেয়।

এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ সার্জন ডা. মোহাম্মদ জিলুর রহমান বলেন, ‘শব্দদূষণ মানুষের বিশেষ করে শিশুদের স্নায়ুগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। ক্রমাগত শব্দদূষণের ফলে কানের টিস্যুগুলো ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়ে। তখন সে আর স্বাভাবিক শব্দ শুনতে পায় না। কানের মধ্যে সব সময় এক ধরনের অস্বাভাবিক শব্দ আসতে থাকে। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে বলে ‘টিনিটাস’। তাছাড়া শিশুদের ক্ষেত্রে হঠাৎ গাড়ির হর্নে লাফিয়ে উঠছে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তারা মানসিকভাবে ভীতু হয়ে পড়ছে। এতে করে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দদূষণের কারণে মনোসংযোগের মারাত্মক বিঘœ ঘটছে। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া মারাত্মকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের এক গবেষণায় বলা হয়; শিশুদের ৩০টি রোগের কারণ ১২ রকমের পরিবেশ ও শব্দদূষণ। তা ছাড়া তীব্র কর্কশ শব্দের ফলে মাতৃগর্ভস্থ শিশু জন্মানোর পর বিকলাঙ্গ, জড় বুদ্ধিসম্পন্ন কিংবা মূক ও বধিরও হতে পারে। এ ছাড়াও কারখানার শ্রমিকদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনকে নিউরোসিস রোগে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। এর মূল কারণ হলো এক নাগাড়ে তীব্র শব্দযুক্ত পরিবেশে অবস্থান। এই রোগে আক্রান্ত শতকরা ৪০ ভাগ শ্রমিক কঠিন মাথার যন্ত্রণায় ভোগেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষ সাধারণত ৬০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ সহ্য করতে পারে। ১৯৮১ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে বলা হয়েছিল ‘মানুষের স্বার্থে শহরাঞ্চলে শব্দের ঊধ্বসীমা হওয়া উচিত ২০ থেকে ৪০ ডেসিবেল। হু-এর মতে শব্দের মাত্রা ৮০ ডেসিবেল হলে একেবারে বধির হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মানুষের বাড়ি এবং কর্মস্থলে বাঞ্ছিত শব্দের মাত্রা হচ্ছে শোবার ঘরে ২৫ ডেসিবেল, খাবার ও বসারঘরে ৩৫ ডেসিবেল, ক্লাস রুমে ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবেল, হাসপাতালে ১৫ থেকে ২৫ ডেসিবেল এবং রেস্তোরাঁতে ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবেল। আর WHO-এর মতে, রাতের শহরের শব্দমাত্রা হওয়া উচিত ৪৫ ডেসিবেল। অথচ শব্দের এ বাঞ্ছিত মাত্রার তুলনায় আমাদের প্রতিনিয়ত অবাঞ্ছিত মাত্রায় শব্দ সহ্য করতে হচ্ছে; যার ফলে মানুষের কঠিন ও মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

আমাদের পরিবেশ নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে শব্দদূষণ একটি। বর্তমানে শহরের শব্দদূষণ যে পর্যায়ে অবস্থান করছে, তা খুবই আশঙ্কাজনক। এর শব্দদূষণের নিরসরের উপায় জনসচেতনতা। বিশ্বব্যাপী মানুষ যেখানে পরিবেশ দূষণ রোধে সোচ্চার। তেমনি আমাদেরও হতে হবে সচেতন। শব্দদূষণের প্রকোপ হ্রাস করার জন্য আমাদের ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ করতে হবে (বৃক্ষ শব্দ শোষণ করে)। কল-কারখানাগুলোতে শব্দদায়ী মেশিনগুলোর যথাযথ আবরণ দিতে হবে। শ্রমিকদের মধ্যে কানের পাগ বিতরণ, বাড়ির দরজা-জানালায় ভারী পর্দা ঝোলাতে হবে। মানতে হবে স্থানভেদে শব্দদূষণের মাত্রা অর্থাৎ ডেসিবেল। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ বা আইন প্রণয়নের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠকসমূহ এবং সংবাদমাধ্যমে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে যারা শিশু, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন। তবে এসবের আগে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিটি মানুষকে শব্দের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। মানুষ সচেতন হলে বহুলাংশে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। অকাল বধিরতা থেকে নিষ্কৃতি পাবে সুসানের মতো অনেক মেধাবী আগামী প্রজন্ম।

লেখক : সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক

জেলা প্রতিনিধি, ডেইলি স্টার, বাংলাদেশ টুডে

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close