ইয়াসমীন রীমা

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২০

প্রতীক্ষা

শিহাবরা ফিরবে কবে

আজ কত দিন হতে চলল মধ্যরাত কিংবা দুপুরের নির্জনতা ভেঙে বেজে ওঠে না আর শিহাবের গিটার থেকে সেই গানের সুর। কারণ এখন নিজেই সে মাদকাসক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর এক নিরাময় কেন্দ্রে ধুঁকছে। তাকে সুস্থ করার জন্য সুন্দর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা চলছে। শিহাব বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সেন্ট যোশেফ স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে নিয়মিত ক্লাসও করছিল। পাশাপাশি গিটারও শিখে ফেলেছিল। দারুণভাবে বইছিল তার জীবনধারা। কিন্তু হঠাৎ এক দিন এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে কেমন বদলে যায় শিহাব। সেই অনুষ্ঠানের কোনো ফাঁকে কে বা কারো দ্বারা তার রক্তের ভেতর ঢুকে পড়ে সেই কাল নাগিনীর বিষের নেশা। তারপর নিয়মিত ড্রাগ এডিক্টটেড হয়ে পড়ে শিহাব। অনিয়মিত হয়ে পড়ে লেখাপাড়ায়। সুস্থ জীবনপ্রবাহ থেকে সরে পড়ে। নেশার আধিক্যে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে তার অভিভাবক তাকে নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে দেন। সেখানে তার চিকিৎসা চলছে আর শিহাবের অভিভাবকদের প্রতীক্ষা চোখ চেয়ে আছে জলদি ফিরছে সুস্থ শিহাব।

একসময় যে অপিয়েট ড্রাগের ব্যবহার ছিল নিছক জ্বরা-ব্যাধি ও বার্ধক্যজনিত নানাবিধ শারীরিক যন্ত্রণা উপশম ও প্রেরণার জন্য। আজ তার নবতর সংস্করণ ব্যবহার হচ্ছে স্কুল-কলেজগামী ছেলেমেয়েদের থেকে শুরু করে অন্যান্য নানা বৃত্তীয় এবং বয়সিদের ফ্যাশন শখ বা আত্মহননের উপায় হিসেবে। গত শতাব্দীতে ড্রাগ সমস্যার কারণ ছিল না। অধিকন্তু অভিজাত ও বিত্তবানদের বিলাসের প্রতীকী উপকরণই ছিল। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, ইতোমধ্যে মাদকদ্রব্যের সর্বনাশা বাঁধনে জড়িয়ে গেছেন বাংলাদেশের ৮০ লাখ লোক এ মরণ নেশার কবলে। বর্তমানে আর ১০টা জাতীয় সমস্যাকে টেক্কা মারতে চাইছে নিষিদ্ধ নেশা। এ-প্রবণতা বহু দেশের অর্থনীতি ভফুন সৃষ্টি করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ধ্বংস করছে। পৃথিবীর সর্বত্রই তরুণদের কাছে মাদকাশক্তি একই রকম আনন্দদায়ক ও উত্তেজনাকর ব্যাপার। এ উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে তারা বেপরোয়া হয়, উপেক্ষা করে প্রচলিত আইনকে এবং নৈতিক দিক থেকে চূড়ান্ত অধঃপতনে নেমে যায়।

মাদকাসক্তদের প্রায় শতকরা ৭০ ভাগই ১২ থেকে ২২ বছর বয়সি। তাদের বেশির ভাগই বন্ধুবান্ধবদের দ্বারা নেশায় আসক্ত হতে দেখা যায়। নেশাগ্রস্ত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ধরা যায় প্রিয়জন থেকে আঘাত পাওয়া বেকারত্বের অভিশাপ, বাবা-মার স্নেহ থেকে বঞ্চনা মাদক ব্যবসার সুবাধে আদান-প্রদান এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত হওয়া। গ্রহণকারীদের সবচেয়ে প্রিয় মাদকদ্রব্য হচ্ছে ফেনসিডিল ও হেরোইন। শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ নেশাগ্রস্তরা তা গ্রহণ করে থাকে। আর বাকিরা অন্যান্য নেশায় আসক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনের পর দিন ফেনসিডিল পান করলে অন্তত ২০ ধরনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রক্তে শ্বেতকণিকা হ্রাস পাওয়া, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, যৌন ক্ষমতা হ্রাস, মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, প্রতিদিন মাথাধরা, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, ক্ষুধামন্দা ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়া।

জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির এক গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, একমাত্র এশিয়া মহাদেশই ৬ লাখ ৯১ হাজার একর জমিতে নিয়মিতভাবে ৩০০ টন হেরোইন উৎপাদন করা হয়। এবং বর্তমান বিশ্বে অবৈধ ড্রাগ অর্থাৎ বিভিন্ন নেশাজাত দ্রব্যের ব্যবসায় প্রতি বছর লেনদেন হয়ে থাকে কমপক্ষে ৪০ হাজার কোটি ডলার। বিশ্বের মোট ব্যবসা-বাণিজ্যের ৮ শতাংশ বর্তমানে ড্রাগ ব্যবসায় জড়িত, যা বিশ্বের মোট টেক্সটাইল ব্যবসার সমপরিমাণ।

বাংলাদেশে চার ধরনের স্পিরিটের ব্যবহার রয়েছে। রেক্টিফায়েড, মিথানল, ডিনেচার্ড এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেথিলেটেড স্পিরিট। মিথানল স্পিরিট শুধু বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। মিথানল স্পিরিট বার্নিশসহ বিভিন্ন কাজে লাগে। মাদক ব্যবসায়ীরা রেক্টিফায়েড স্পিরিটের সঙ্গে পানি ও মিথানল স্পিরিট মিশিয়ে বিশেষ এক ধরনের মদ তৈরি করে। অনেকে আবার নেশা বেশি হওয়ার জন্য ঘুমের ওষুধজাতীয় ট্যাবলেট মেশায়। গত তিন বছরে দেশে বড় ধরনের ১০টি স্পিরিট ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটেছে। দিনের পর দিন তাদেরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারে ঝরে গেল অনেকগুলো জীবন। অনেকে বেঁচে থেকেও বরণ করছে পঙ্গুত্বে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন থিয়েটার অ্যান্ড আটস ফর লেস ফরচুনেট (টালফ)-এর উদ্যোগে নিয়মিত মাদকসেবীদের ওপর তিন মাসব্যাপী চট্টগ্রামের মাদক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে এক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছাত্র, ড্রাইভার বেকারসহ মোট ১০টি পেশার ৪১২ জন মাদকসেবী জরিপে মতামত প্রদান করেন। এত ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সি মাদকসেবীরা টালফের মোট ১২টি প্রশ্নের ওপর মতামত প্রদান করেন। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ‘১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সি মাদকসেবীর সংখ্যা ৩৪ দশমিক ৯৬ ভাগ। মাদকসেবীদের মধ্যে শতকরা ১১ দশমিক ৬৫ ভাগ অশিক্ষিত। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া জানে ১৫ দশমিক ২৯ ভাগ মাদকসেবী। এ ছাড়া ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত শতকরা ১০ দশমিক ৯২ ভাগ, এসএসসি পাস ২২ দশমিক ৮২ ভাগ, এইচএসসি পাস ১৯ দশমিক ৬৬ ভাগ এবং ডিগ্রি থেকে ওপরে ১৯ দশমিক ৬৬ ভাগ মাদকসেবী। যাদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ৮৫ ভাগ অবিবাহিত এবং ৪৪ দশমিক ৬৬ ভাগ বিবাহিত।

জরিপে অংশগ্রহণকারী মাদকসেবীদের মধ্যে শতকরা ৭২ দশমিক শূন্য ৯ ভাগ মাদকসেবী ১১ থেকে ২০ বছর বয়সে মাদকাসক্ত হয়। যার মধ্যে শতকরা ১৫ দশমিক ২৯ ভাগ মাদকাসক্ত হয় ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সে এবং ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সে ৫৬ দশমিক ৮০ ভাগ। শতকরা ২৬ দশমিক ৪৬ ভাগ মাদকসেবী ৫ বছর পর্যন্ত মাদক সেবন করেছেন এবং ৬ থেকে ১০ বছর ৩৭ দশমিক ১৪ ভাগ ও ১১ থেকে ১৫ বছর যাবৎ মাদক সেবন করেছে ২২ দশমিক ৩৩ ভাগ। শতকরা ৭৬ দশমিক ৯৪ ভাগ মাদকসেবী মাদকাসক্ত হয়েছে বন্ধুর প্রভাব এবং মাদকের প্রতি কৌতূহলের কারণে। প্রতিকূল পারিবারিক পরিবেশ ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলার কারণে ১৪ দশমিক ৫৬ ভাগ এবং বেকারত্ব হতাশা ও আর্থিক অনটনের কারণে শতকরা ৬ দশমিক ৫৫ ভাগ মাদকসেবী মাদকাসক্ত হয়েছে। মাদকসেবীদের মধ্যে শতকরা ৬৭ দশমিক ৪১ ভাগ হেরোইন সেবনকরণে এবং ১১ দশমিক ৪১ ভাগ মাদকসেবী নিয়মিত ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করে। সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদকসেবীর মধ্যে শতকরা ২২ দশমিক ৮২ ভাগ মাদকসেবী একই সিরিঞ্জে কয়েকজন মিলে মাদক গ্রহণ করে এবং জরিপে অংশগ্রহণকারী সব মাদকসেবীর মধ্যে শতকরা ৩২ দশমিক শূন্য ৪ ভাগ মাদকসেবীই জানেন না যে, একই সিরিঞ্জে একাধিক ব্যক্তি মাদক গ্রহণ করায় এইচআইভি/এইডস বা বিভিন্ন প্রকার যৌনরোগে আক্রান্ত হতে পারে। কেননা, মাদকসেবীদের মধ্যে শতকরা ৭৩ দশমিক শূন্য ৬ ভাগ মাদকসেবী যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌনমিলনসহ বিভিন্ন প্রকার অপরাধকর্মে জড়িত। মাদক সেবনে ব্যয় নির্বাহের জন্য শতকরা ৫৭ দশমিক ৫২ ভাগ মাদকসেবী নিজস্ব পেশার আয়ের ওপর নির্ভরশীল এবং শতকরা ২৭ দশমিক ১৮ ভাগ পরিবার থেকে ও শতকরা ১৫ দশমিক ৩০ ভাগ প্রতারণা, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের মাধ্যমে ব্যয় নির্বাহ করে থাকে।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পড়ে। কালক্রমে ‘ড্রাগ’ হয়ে উঠছে আমাদের একটি প্রধান জাতীয় ইস্যু। মিছিল, শোভাযাত্রা, বক্তব্য-বিবৃতিতে আজ গোটা জাতি মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। মাদকদ্রব্য প্রতিহত করার জন্য সরকারি পর্যায়ে জাতীয় কমিটি গঠনসহ বেসরকারি পর্যায়ে অগণিত জাতীয় এবং স্থানীয় সংগঠন গড়ে উঠেছে। সরকার ১৯৯০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এ অধিদফতরে নিবন্ধকৃত ১২৭টি এনজিও বর্তমানে সারা দেশে মাদকবিরোধী কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করছে। এ ছাড়া মাদকদ্রব্যের চাহিদা হ্রাসের জন্য ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে চারটি মাদকাসক্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ কেন্দ্রগুলোতে ইনডোর ও আউটডোর বিভাগে রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়। এ ছাড়াও মাদকদ্রব্য বিষয়ক একটি সুষ্ঠু আইন রয়েছে যদি কারো কাছে ২৫ গ্রামের হেরোইন পাওয়া যায় তার মৃত্যুদন্ড অনিবার্য।

বাংলাদেশে বৈধ ডিলারের সংখ্যা ৮৭৭টি। উৎপাদিত রেক্টিফায়েড স্পিরিটের অর্ধেকেরও বেশি পরিমাণ স্পিরিট সাধারণত ডেনোচার্ড স্পিরিট রূপান্তরিত করা এবং আসবাবপত্র বার্নিশের কাজে ব্যবহৃত হয়। অথচ হিসাব অনুযায়ী, বাজারে যে স্পিরিট আছে, তা উৎপাদনের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের উৎপাদিত রেক্টিফায়েড স্পিরিটের ওপর কাগজে-কলমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও রেক্টিফায়েড স্পিরিটের সঙ্গে যে মিথানল বা মিথাইল অ্যালকোহল মিশিয়ে নেশার বস্তু হিসেবে বিক্রি হয়, সেই মিথানল আমদানিতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রচলিত আমদানিনীতিতে যে কারো সুযোগ রয়েছে; যা সাহসী করে তুলছে মাদক ব্যবসায়ীদের। পাশাপাশি তারা হাজার হাজার তরুণকে অন্ধকার জগতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতার সৃষ্টি হয় প্রাচীনকাল থেকেই। সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই হোক বা বিভিন্ন সচেতন মহলের চাপেই হোক, মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকবিরোধী অভিযানে অংশ নেয়। কালেভাদ্রে দু-একজন ধরা পড়লেও খুব সহজেই আইনের ফাঁকে বেরিয়েও আসে। কিন্তু দেশের স্বার্থে দশের স্বার্থে এই কঠিন কাজটি আমাদের করতেই হবে, ধ্বংস করে দিতে হবে মাদক ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্রকে। প্রয়োজনে সব মহলের মতৈক্য সৃষ্টি করতে দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। সামাজিক আন্দোলন আরো বেশি জোরদার করতে হবে। শিহাবের মতো হাজারো কিশোর-তরুণকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে সুস্থ-সুন্দর জীবনের কোলাহলে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close