আরাফাত বিন হাসান

  ১৮ জানুয়ারি, ২০২০

বিশ্লেষণ

মগজের ময়লা দূর করতে হবে

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাবমতে, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জনে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আর নতুন বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ নতুন বছরের প্রথম ১২ দিনে দেশের প্রথম সারির জাতীয় পত্রিকাগুলোর খবর অনুযায়ী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন অন্তত ২৫ জন নারী। সকাল দেখে নাকি দিনটা কেমন যাবে, কিছুট অনুমান করা যায়। সুতরাং নতুন বছরের প্রথম ১২ দিনে যদি ২৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, বছরের বাকি দিনগুলোতে কী হবে!

ধর্ষণ মূলত কেন হয়? সাইকিয়াট্রিস্ট ফ্রয়েডের মতে, মানব মন মূলত তিনটি সত্তার সমন্বয়ে গঠিত ইড, ইগো এবং সুপার ইগো। এখানে ইড হলো লোভ তথা সব স্বাভাবিক খারাপ প্রবৃত্তি। এই ইড প্রায় সব প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান। অর্থাৎ মানুষের মনে ইডের উপস্থিতি মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করতে পারে না। বাকি দুটোই অর্থাৎ সুপার ইগো এবং ইগো মিলেই মূলত মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে। সুপার ইগো ইডের কাজে বাধা দেয়। ইডের কারণে মানুষ কোনো খারাপ কাজ করতে চাইলে সুপার ইগো সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর ইগো ইড ও সুপার ইগোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকে।

একবার আমার এক স্কুলশিক্ষক আমাদের জীবনকালের সঙ্গে একটা আয়নার তুলনা করেছিলেন। তার মতে, একটা নতুন পরিষ্কার আয়নার মতো জীবনের শুরুর দিকে আমরা নির্ভেজাল-নিষ্পাপ থাকি। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন নতুন আয়নাটার গায়ে ধুলো-ময়লা পড়ে ঝাপসা হয়ে যায়, আমরাও জীবনকাল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে কলুষিত হয়ে যাই। তবে চাইলেই যেকোনো সময় সেই আয়নার ধুলাবালিগুলো মুছে পরিষ্কার করা যায়, তেমনি আমরাও চাইলে সব কলুষতা ঝেড়ে কলুষমুক্ত হতে পারি। আবার আয়নাটি প্রতিদিন মুছা হলে যত সময়ই যাক, ধুলাবালি পড়ে ঝাপসা হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। তেমনি আমরাও চাইলে নিজেদের তিলে তিলে কলুষমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে পারব, যদি নিয়মিতি নিজেদের পরিচর্যা করি। আগে যে মানব মনের তিনটা সমন্বয়ক ইড, সুপার ইগো আর ইগোর কথা বলা হয়েছে; এর কার্যক্রমের সঙ্গে আয়নার এই গল্পের বিশেষ সম্পর্ক আছে।

কেউ যদি ইডের প্ররোচনায় একটা ধর্ষণে জড়িয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে সুপার ইগোর কারণে তার মধ্যে অনুশোচনার সৃষ্টি হবে। সুপার ইগোর কারণে ওই লোক ভীষণ অনুতপ্ত হবে। কিন্তু এই অনুতপ্ত হওয়া কিংবা অনুশোচিত হওয়াকে পাশ কাটিয়ে ইডের প্ররোচনায় ধর্ষণকাজ বা অন্য কোনো খারাপকাজ নিয়মিত চলতে থাকে; তাহলে সুপার ইগোর গায়ে ধীরে ধীরে ধুলোবালি জমে ঝাপসা হয়ে যাবে ওই আয়নার মতো। একসময় এই সুপার ইগো আর স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করবে না। তবে ওই ধুলো জমা আয়নার মতো চাইলে সুপার ইগোর গায়ে জমে থাকা ধুলাবালিগুলো পরিষ্কার করা যাবে। সব ময়লা দূরে করা যাবে।

এই যে ধর্ষণ, এটা মানুষের মনে ইডের প্রভাবে জায়গা করে নেয় ঠিক; তবে এর পেছনে আরো বেশ কিছু কারণ আছে। ধর্ষক কোন পরিবেশে বেড়ে ওঠেছে, কেমন সঙ্গীর সঙ্গে সে মিশছে, সে কী কী শিখছেÑ এসবও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবেশ। আমরা কেমন পরিবেশে বড় হচ্ছি, চার পাশে কী কী দেখে বড় হচ্ছি, কেমন মানসিকতার মানুষ দেখে বড় হচ্ছিÑ এগুলো একজন ধর্ষককে ধর্ষক বানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ আমাদের সামনে যদি নারীকে সর্বক্ষেত্রে ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়; তখন ধীরে ধীরে এটা মানসিকতায় গেঁথে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এলিট শ্রেণি থেকে শুরু করে সমাজের একদম নিম্নস্তর প্রর্যন্ত এখনো নারীদের ভোগ্যপণ্য হিসেবেই উপস্থাপন করে থাকে। চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সিনেমা, সাহিত্য মোটামুটি সব জায়গায় কৌশলে নারীদের পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করার মানসিকতা রয়েছে। আর এটাই শত শত ধর্ষককে ধর্ষক হিসেবে তৈরি হতে সাহায্য করছে। ধর্ষকের মানসিকতায় যদি ছেঁদানো থাকে যে, নারী মানেই পণ্য, তখন ধর্ষণ করার সময় নারী আপাদমস্তক ঢাকা নাকি ২ মাস বয়সি শিশু তা চিন্তা করার প্রয়োজন পড়ে না।

সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সময় এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করার যে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল একইভাবে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ যে মহামারি রূপে দেখা দিয়েছে; যত দ্রুত সম্ভব ধর্ষকদের লার্ভা ধ্বংসের কাজে নেমে পড়তে হবে। আর এসব ধর্ষকের লার্ভা মূলত ‘নারীকে পণ্য ভাবা’ সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে আছে। আমাদের মগজে-মননে এই যে মানসিকতাটা গেঁথে আছে, তা যত দিন পরিষ্কার সম্ভব হচ্ছে না, তত দিন ধর্ষণের এই মহামারি থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close