প্রকৌশলী রিপন কুমার দাস

  ১৮ জানুয়ারি, ২০২০

মুক্তমত

গন্তব্যহীন থেকে গন্তব্যের পথে

আমাদের দেশের সাধারণ শাখার শিক্ষার্থীরা এসএসসি, এইচএসসি, ডিগ্রি ও মাস্টার্স এবং মাদরাসা শাখার শিক্ষার্থীরা দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল বিষয়ে অধ্যয়ন করতে পারেন। কিন্তু ভোকেশনাল শাখার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এসএসসি ভোকেশনাল কোর্স সম্পন্ন করার পর পরবর্তীতে আর ভোকেশনাল শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। যদিও কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী নির্দিষ্টসংখ্যক ট্রেডে জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এইচএসসি ভোকেশনাল কোর্সে অধ্যয়ন করে থাকেন। আর এখানেই তাদের ভোকেশনাল শিক্ষায় শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায়। পরবর্তীতে কোনো শিক্ষার্থীই আর ভোকেশনাল শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত হতে পারেন না আর এটাই হলো গন্তব্যহীন ভোকেশনাল শিক্ষা।

বর্তমানে ২৫০০ এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ৬৪টি প্রতিষ্ঠানে এইচএসসি ভোকেশনাল কোর্স পরিচালিত হয়ে থাকে অর্থাৎ এসএসসি ভোকেশনাল কোর্স করার পর মাত্র শতকরা ৩ ভাগ শিক্ষার্থী এইচএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রমে শিক্ষার সুযোগ পায়। তাই এসএসসি পর্যায়ে ভোকেশনাল শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে অন্তত ১টি করে প্রতিষ্ঠান চালু করা প্রয়োজন, একই সঙ্গে দেশে সব মাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি বিদ্যালয়সমূহে এসএসসি ভোকেশনাল কোর্স চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া ভোকেশনাল শিক্ষাক্রমের শিক্ষার্থী সংকট দূর করার জন্য বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ডের অধীনে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার জন্য জেএসসি ভোকেশনাল, আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার জন্য জেডিসি ভোকেশনাল, কওমি মাদরাসা শিক্ষার জন্য মুতাওয়াস সিতাহ্ ভোকেশনাল এবং সংস্কৃত ও পালি প্রতিষ্ঠানের জন্য নিম্নাদ্য ভোকেশনাল চালু করা প্রয়োজন। একইভাবে বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার জন্য এসএসসি ভোকেশনাল, আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার জন্য দাখিল ভোকেশনালের পাশাপাশি কওমি মাদরাসা শিক্ষার জন্য সানাবিয়্যাহ আম্মাহ ভোকেশনাল এবং সংস্কৃত ও পালি প্রতিষ্ঠানের জন্য আদ্য ভোকেশনাল চালু করা প্রয়োজন।

এসএসসি ভোকেশনাল পাসকৃত শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বর্তমানে জেলা ও উপজেলা সদরে অবস্থিত এসএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে এইচএসসি ভোকেশনাল কোর্স চালু করা যেতে পারে, ফলে অনেক শিক্ষার্থীর এইচএসসি ভোকেশনাল শিক্ষা গ্রহণ করতে সম্ভব হবে। এ ছাড়া অনুৎপাদনশীল এইচএসসি ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা শিক্ষাক্রমকে এইচএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রমে রূপান্তর করাও জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ডের অধীনে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার জন্য এইচএসসি ভোকেশনালের পাশাপাশি আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার জন্য আলিম ভোকেশনাল, কওমি মাদরাসা শিক্ষার জন্য সানাবিয়্যাহ খাস্সাহ ভোকেশনাল এবং সংস্কৃত ও পালি প্রতিষ্ঠানের জন্য মধ্য ভোকেশনাল চালু করা প্রয়োজন।

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের এইচএসসি ভোকেশনাল কোর্সটি এইচএসসি (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা), এইচএসসি (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স) এইচএসসি (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (এগ্রিকালচার সায়েন্স) নামে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করার প্রয়োজন রয়েছে। আলিম ভোকেশনাল কোর্সটি আলিম (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (সাধারণ), আলিম (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স), আলিম (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (ব্যবসায় শিক্ষা), আলিম (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (মুজাব্বিদ মাহির) নামে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করার প্রয়োজন রয়েছে। মধ্য ভোকেশনাল কোর্সটি মধ্য (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (সাধারণ), মধ্য (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স), মধ্য (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (ব্যবসায় শিক্ষা) নামে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করার প্রয়োজন রয়েছে। ভোকেশনাল শিক্ষার ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এইচএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রম পর্যন্ত অর্থাৎ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ভোকেশনাল শিক্ষার সব বোর্ড পরীক্ষার কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড হতে পৃথক করে বাংলাদেশ ভোকেশনাল শিক্ষা বোর্ড নামে নতুন বোর্ড গঠন করার প্রয়োজন রয়েছে।

এইচএসসি ভোকেশনাল ও এইচএসসি সমমান কোর্স পাসকৃত শিক্ষার্থীদের জন্য B.A, B.B.S, B.S.S, B.Sc-এর ন্যায় ৩ বছর মেয়াদি পাস কোর্সে B.Voc/ স্নাতক (ভোকেশনাল) চালুকরণ প্রয়োজন। এই কোর্স সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি কলেজসমূহে এই B.Voc/স্নাতক (ভোকেশনাল) কোর্স চালু করা যেতে পারে। B.Voc/স্নাতক (ভোকেশনাল) কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে এইচএসসি ভোকেশনাল ও এইচএসসি ব্যবসায় ব্যবস্থাপনাসহ যেকোনো বিভাগের এইচএসসি ও আলিম পাসকৃতদের জন্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে। একইভাবে ¯স্নাতক পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষার জন্য B.Voc/স্নাতক (ভোকেশনাল)-এর ন্যায় আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার জন্য ফাজিল ভোকেশনাল, কওমি মাদরাসা শিক্ষার জন্য মারহালাতুল ফজিলাত ভোকেশনাল এবং সংস্কৃত ও পালি প্রতিষ্ঠানের জন্য উপাধি ভোকেশনাল চালু করা প্রয়োজন।

B.Voc/স্নাতক (ভোকেশনাল) পর্যায়ের স্নাতক (ভোকেশনাল) কোর্সটি বিবিএস (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম, বিএসসি (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স), বিএসসি (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম (এগ্রিকালচার সায়েন্স) নামে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করার প্রয়োজন রয়েছে। ফাজিল ভোকেশনাল কোর্সটি ফাজিল বিবিএস (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম, ফাজিল বিটিআইএস (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম, ফাজিল বিএ (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম, ফাজিল বিএসএস (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম নামে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করার প্রয়োজন রয়েছে। উপাধি ভোকেশনাল কোর্সটি বিভাগসমূহ উপাধি বিবিএস (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম, উপাধি বিএ (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রম নামে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করার প্রয়োজন রয়েছে।

তারপর ভোকেশনাল শিক্ষায় স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দুই বছর মেয়াদি M.Voc/স্নাতকোত্তর (ভোকেশনাল) কোর্স চালু করা প্রয়োজন। এই কোর্স সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি কলেজসমূহে এই M.Voc/স্নাতকোত্তর (ভোকেশনাল) কোর্স চালু করা যেতে পারে। দুই বছর মেয়াদি M.Voc/স্নাতকোত্তর (ভোকেশনাল) কোর্স ভর্তির যোগ্যতা হবে B.Voc/স্নাতক (ভোকেশনাল) ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলী বা কৃষি ডিপ্লোমা বা সমমান। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার জন্য M.Voc/স্নাতকোত্তর (ভোকেশনাল)-এর ন্যায় আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার জন্য কামিল ভোকেশনাল, কওমি মাদরাসা শিক্ষার জন্য মারহালাতুল তাকমিল (দাওরায়ে হাদিস) ভোকেশনাল এবং সংস্কৃত ও পালি প্রতিষ্ঠানের জন্য উপাধিত্তর ভোকেশনাল চালু করা প্রয়োজন।

M.Voc/স্নাতকোত্তর (ভোকেশনাল) পর্যায়ের স্নাতকোত্তর (ভোকেশনাল) কোর্সটিতে এমবিএ (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রমে হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং নামে তিনটি বিভাগ থাকবে। এমএসসি (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রমে রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান নামে পাঁচটি বিভাগ থাকবে। কামিল (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রমে আরবি, হাদিস, তাফসির, ফিকহ নামে চারটি বিভাগ থাকবে। উপাধিত্তর (ভোকেশনাল) শিক্ষা কার্যক্রমে সংস্কৃত, বেদ ও বেদান্ত, পুরাণ, স্মৃতিশাস্ত্র নামে চারটি বিভাগ থাকবে।

এ ছাড়া ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ার পাসকৃত ভোকেশনাল শিক্ষকদের শিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য এক বছর মেয়াদি ই.ঠ.ঊফ কোর্র্স চালু করার যেতে পারে। ই.ঠ.ঊফ কোর্স পাসকৃতদের জন্য এক বছর মেয়াদি গ.ঠ.ঊফ কোর্স চালু করা যেতে পারে। এইচএসসি ভোকেশনাল শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এর ন্যায় পৃথক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৃত্তিমূলক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন; যেখানে B.Voc/স্নাতক (ভোকেশনাল), M.Voc, B.V.Ed, M.V.Ed কোর্স চালু করা যেতে পারে।

উল্লিখিত কোর্সসমূহকে ঘঞঠছঋ-এর আওতায় নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের জন্য Lebel প্রি-ভোক-১ : ষষ্ঠ শ্রেণি, খবনবষ প্রি-ভোক-২ : ৭ম শ্রেণি, Lebel NSC-1 : (বেসিক ওয়ার্কার) ৮ম শ্রেণি, মাধ্যমিক স্তরের জন্য Lebel NSC-2 : (বেসিক স্কিলড ওয়ার্কার) এসএসসি ভোকেশনাল, উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জন্য Lebel NSC-3 : (সেমি স্কিলড ওয়ার্কার) এইচএসসি ভোকেশনাল, স্নাতক স্তরের জন্য Lebel NSC-4 : (স্কিলড ওয়ার্কার) B.Voc, ¯স্নাতকোত্তর স্তরের জন্য Lebel NSC-5 : (হাইলি স্কিলড ওয়ার্কার/সুপার ভাইজার) M.Voc/স্নাতকোত্তর (ভোকেশনাল) করা যেতে পারে।

এ ছাড়া ভোকেশনাল শিক্ষার ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাস্টার্স শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষকের বেতন-ভাতাদি ও অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পনè করার জন্য কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর হতে পৃথক করে ভোকেশনাল শিক্ষা অধিদফতর নামে নতুন অধিদফতর গঠন করা যেতে পারে। এইচএসসি ভোকেশনাল, B.Voc/স্নাতক (ভোকেশনাল), M.Voc/স্নাতকোত্তর (ভোকেশনাল) কোর্সের জন্য শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এসএসসি ভোকেশনালে কর্মরত ট্রেড ইনস্ট্রাক্টরদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ করা যেতে পারে।

লেখক : ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর

ডোনাভান মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পটুয়াখালী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close