ডা. এস এ মালেক

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

পর্যালোচনা

ইতিহাসের বর্বরোচিত ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কয়েক হাজার বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল। তারা শিকার হয়েছিলেন নির্মম, পাষন্ড ও বর্বর হত্যাকান্ডের। ৯ মাসব্যাপী পাক হানাদার বাহিনী এ দেশের রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সহায়তায় এ যুদ্ধ সংঘটিত করেছিল। কিন্তু বেছে বেছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বধ্যভূমিতে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দুদিন আগে। দেশে কয়েক সহস্র বধ্যভূমি ছিল। যেখানেই হানাদার বাহিনী ঘাঁটি গড়েছিল জেলা, মহকুমা, বিভাগীয় শহরে তাদের ক্যাম্পের চারদিকে ছিল একাধিক বধ্যভূমি। গ্রাম থেকে নিরীহ লোকদের ধরে এনে বা আটক, ধর্ষিত নারীদের নির্মমভাবে বধ্যভূমিতে হত্যা করা হতো। তারপর হয় মাটির তলে চাপা দেওয়া হতো অথবা বস্তায় ভরে নিকটবর্তী নদীতে বা জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হতো। তৎকালীন মহকুমা শহর রাজবাড়ীতে বধ্যভূমি ছিল শ্রীপুরে। ৯ মাসে সেখানে প্রায় ১৪ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা শহরে রায়ের বাজারে যে বধ্যভূমি সারাবিশ্ব জানতে পেরেছে, সেখানে মাত্র দু-তিন দিনের মধ্যে কয়েকশ বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে এসে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া মাসের পর মাস বিভিন্ন টর্চার সেলে কারো আঙুল বা জিহ্বা কেটে দেওয়া হতো। সেই প্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধকে রাজনৈতিক সমাধানের শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা অনেকে বিজয়ের কথা জানি। তারা রাজ্যকে বিস্তৃত করার লক্ষ্যে বর্বর হত্যাকান্ড চালিয়ে দেশ দখল করেছে। বিশ্ববীর হিসেবে খ্যাত এসব কুলাঙ্গার যেভাবে বিশ্বসভ্যতাকে ধ্বংস করেছে, তা অবর্ণনীয়। দুটি বিশ্বযুদ্ধে যত লোক প্রাণ দিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি জীবন দিতে হয়েছে এসব দিকবিজিতের হাতে। আমরা বাঙালিরা শুধু যুদ্ধ দেখিনি, যুদ্ধ করেছি এবং তা করতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছি। ৯ মাসে ৩০ লাখ বাঙালিকে জীবন দিতে হয়েছে। ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছে ৩ লাখ মা বোনের। যুদ্ধের কারণে বিধ্বংস হয়েছে সোনার বাংলা। আসলে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের সংগ্রামের প্রকৃতি ছিল রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক সংকট সমাধানের লক্ষ্যে তিনি পাকিস্তানের কাছে একটা ফর্মুলা দিয়েছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তান এমন একটা সংবিধান কর্তৃক পরিচালিত হোক, যেখানে সব নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে। ওই অধিকার ছিল ৬ দফায়। পাকাপোক্তভাবে ৬ দফাভিত্তিক সংবিধান করে সব বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে পাকিন্তান স্বশাসিত হোক। তিনি শুধু পূর্ব পাকিস্তান নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না। গণতান্ত্রিক পথে সংকটের সমাধানের চাইতে আর বিকল্প পথ খোলা ছিল কি? পাক হানাদার বাহিনী যদি পাকিস্তান সংরক্ষণে আগ্রাসিত না হতো, তাহলে পূর্ব বাংলাকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে অন্তত পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো রক্ষা করতে পারত। কিন্তু তা না করে তারা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি ও বাংলাদেশ ভূখন্ডকে চিরতরে পদানত করতে চাইছিল। সুতরাং পাকিস্তানিরা যুদ্ধ ঘোষণা করে মূলত পাকিস্তান ভাঙার প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু যথাসময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং সর্বাত্মক প্রতিরোধের মাধ্যমে পাকিস্তানের শেষ সৈন্যটিকে বিতারিত করে বাংলাদেশ স্বাধীন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ২৬ মার্চ যে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর তা বাস্তব রূপ লাভ করে। সশস্ত্র যুদ্ধ চলেছে ৯ মাস। বিপ্লবী সরকার গঠন করে বিদেশের মাটি থেকে এই যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু এই যুদ্ধের প্রকৃতি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। পাকিস্তান চেয়েছিল বাংলাদেশকে দখল করে রাখতে আর বাংলাদেশ চেয়েছিল পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি। যুদ্ধ হবে দুই দেশের হানাদার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে নিরস্ত্র নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হবে কেন? যুদ্ধের সময় দেখা গেছে, পাক হানাদাররা রাজাকার, আলবদর বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। একেক বাড়ির প্রাঙ্গণে শত শত মহিলাকে জোরপূর্বক দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে। শুধু ঘববাড়ি নয়, খাদ্যশস্য ও গৃহপালিত পশুপাখিদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে যুদ্ধের সব রীতিনীতি লঙ্ঘন করে তারা গণহত্যা চালিয়েছে। যে গণহত্যার বিচার বিশ্বসভ্যতা এখনো করতে পারেনি বা করার কোনো উদ্যোগও নেয়নি। ১৪ ডিসেম্বর তারা ভালোভাবেই জানত অচিরেই তাদের পতন ঘটে যাচ্ছে। এভাবে সুনিশ্চিত হয়েই তারা কেন রাতের অন্ধকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশায় নিয়োজিত সুসন্তানদের চোখ বেঁধে বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করল। আর রাজাকার বাহিনী তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করল। এখানে একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ তো স্বাধীন হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারে, সে কারণে যাদের ওপর ভর করে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে, তাদের হত্যা করে এমন বাস্তব অবস্থার সৃষ্টি করা, যাতে করে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার যে সম্পদ ও শক্তির ওপর ভর করে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সেখানে শূন্যতা সৃষ্টি করা। বাস্তবে ঘটেছিল তাই। অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মতো দার্শনিক আর একজন কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি। ডা. আলীমের মতো চক্ষুবিশেষজ্ঞ কজন হয়েছে। ডা. রাব্বী ও মুনীর চৌধুরীর মতো আলোকিত মানুষ, এরূপ শত শত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান যারা বেঁচে থেকে দেশের কাজে নিয়োজিত থাকলে অনেক আগেই দেশের চেহারা পাল্টে যেতে পারত। তারা অকালেই ঝরে গেছেন। এরাই ছিলেন বাঙালি জাতির প্রাণশক্তি। বাংলাদেশে যেসব সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনা হয়েছে, এরাই তার পাটভূমি রচনা করেছেন। সে কারণেই শত্রুরা তাদের স্বরূপ চিনতে ভুল করেনি। আমার বেশ মনে আছে ৮ ডিসেম্বর যখন গোপালগঞ্জ স্বাধীন হলো; তখন গোপালগঞ্জের একজন ক্যাপ্টেন ও ২২ জন পাকিস্তানি সৈন্য রেজি. সৈন্য এবং ৩৫০ বাঙালি রাজাকার ছিল। ৭ ডিসেম্বর রাতে কাথির স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে কয়েক হাজার মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতিতে আমি মাইকের মাধ্যমে বাঙালি রাজাকারদের অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করতে বলি। আর পালিয়ে যাওয়া বেলুচ ক্যাপ্টেন তার সেনাসদস্যসহ শ্রীপুরের আকবর চেয়ারম্যানের হাতে ধরা পড়ে এবং পরদিন কয়েক হাজার লোক নিয়ে গোপালগঞ্জ কলেজের সামনে পতাকা উত্তোলন করি। এ সময়ে বর্তমান ধর্ম প্রতিমন্ত্রী আলহাজ শেখ মো. আবদুল্লাহ, গোপালগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ও আদালতের মুনসেফসহ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলি। তখন এরপর সেই বেলুচ পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে ও আনুগত্য স্বীকার করে। সেদিন ইচ্ছা করলে তাদের টুকরো টুকরো করে মারতে পারতাম। কিন্তু জেনেভা কনভেনশনের আইন মোতাবেক তা আমরা সেদিন করিনি। আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের যা করা দরকার তাই করেছি মাত্র। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বীর শহীদ হয়েছেন এবং যেসব বুদ্ধিজীবী জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য, তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তাদের আত্মত্যাগ জাতি কোনো দিন ভুলবে না। তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব।

লেখক : বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close