ইসমাইল মাহমুদ

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধ

শহীদের গ্রাম ‘লইয়ারকুল’

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষের ভূমিকা উজ্জ্বল। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এ দেশের ৩০ লাখ দেশপ্রেমিক মুক্তিসেনা শহীদ হন এবং সম্ভ্রম হারান প্রায় ২ লাখ মা-বোন। এ দেশের যেসব গ্রাম আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে; সে গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি গ্রাম হলো মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ২নং ভুনবীর ইউনিয়নের ‘লইয়ারকুল’। এ গ্রামের অধিকাংশ তরুণ-যুবক মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে দেশের বিজয় ত্বরান্বিত করতে অনবদ্য অবদান রাখেন। অসংখ্য মুক্তিসেনার এ গ্রামের ছয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেদের প্রাণ।

লইয়ারকুল গ্রামের ছয়জন শহীদ মুক্তিসেনা হলেনÑ ১. শহীদ রহিম উল্লাহ, পিতা : জরিফ উল্লাহ; ২. শহীদ জৈন উল্লাহ, পিতা : জরিফ উল্লাহ; ৩. শহীদ কদর আলী, পিতা : আম্বর আলী; ৪. শহীদ আলী আকবর, পিতা : আবদুল ছোবহান; ৫. শহীদ আলী আজগর, পিতা : আবদুল ছোবহান এবং ৬. শহীদ আবদুর রহমান, পিতা : সিকন্দর উল্লাহ।

শহীদ রহিম উল্লাহ, শহীদ জৈন উল্লাহ ও শহীদ আবদুর রহমান : শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের জরিফ উল্লাহর দুই ছেলে জৈন উল্লাহ ও রহিম উল্লাহ এবং একই গ্রামের সিকন্দর উল্লার ছেলে আবদুর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে আশ্রয় নেন। একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে তারা সিলেট-আখাউড়া রেলওয়ে সেকশনের উদনা নদীর ওপরের ব্রিজ ধ্বংস করার ‘মিশন’ নিয়ে ভারত থেকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। উদ্দেশ্য সফলের লক্ষ্যে তারা সাতগাঁও বাজারে দোকান কর্মচারীর কাজ নেন। ওই সময়ে তাদের অপর এক সহযোগী শ্রীমঙ্গল শহরে পাক বাহিনীর হাতে আটক হন। পাক হায়েনাদের নির্যাতনের মুখে এ পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন। পাক বাহিনী তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাতগাঁও থেকে শহীদ রহিম উল্লাহ, শহীদ জৈন উল্লাহ ও শহীদ আবদুর রহমানকে আটক করে শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন শুরু করে। তাদের সঙ্গে একত্রিত করে নির্যাতন চালানো হয় একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কদর আলীর ওপরও। কয়েক দিন নির্মম নির্যাতনের পর ৭১-এর ৬ জুন এই চার মুক্তিযোদ্ধাকে শ্রীমঙ্গল শহরের বর্তমান বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন দুই ছেলেকে দেখতে ক্যাম্পে গিয়েছিলেন জরিফ উল্লাহ। পাক হায়েনারা যখন তার দুই ছেলেকে নিয়ে বধ্যভূমিতে রওনা হয়; তখন পিতা জরিপ উল্লাহও তাদের পিছু পিছু অগ্রসর হন। পাক সেনাদের পায়ে ধরে তিনি তার দুই ছেলেকে মুক্ত করার আকুতি জানান। কিন্তু পাক হায়েনারা তাদের জয় বাংলায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানায়। পিতার চোখের সামনেই গর্জে উঠে পশুদের হাতের অস্ত্র। মুহূর্তেই দুই ভাই জৈন উল্লাহ ও রহিম উল্লাহ, আবদুর রহমান এবং কদর আলীর বুক ঝাজড়া হয়ে যায় পাক হায়েনাদের বুলেটে। বধ্যভূমিতে লুটিয়ে পড়েন তারা। জরিপ উল্লাহ তার দুই ছেলের লাশ আনতে চাইলে তাতেও বাধা দেয় পশুর দল। পুত্রদ্বয়ের মৃত্যুশোকে কাতর পিতা হেঁটে শ্রীমঙ্গল থেকে রওনা হন লইয়ারকুল গ্রামস্থ বাড়ির উদ্দেশে। কিন্তু বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি তিনি। গ্রামের প্রবেশমুখে বটগাছের তলায় বসে প্রাণ ত্যাগ করেন জরিফ উল্লাহ। পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যুর আঘাতে একাত্তরেই প্রাণ হারান জরিফ উল্লাহর তৃতীয় ছেলে কনর মিয়া।

শহীদ কদর আলী : ভুুনবীর ইউনিয়নের লইয়ারকুল গ্রামের আম্বর আলীর ছেলে কদর আলী ছিলেন দুঃসাহসী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ২৬ বছর। টগবগে তরুণ। যুদ্ধ শুরুর ৬ মাস আগে তিনি বিয়ে করেন। শেরপুরের ভয়াবহ যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। সেখান থেকে যুদ্ধের একপর্যায়ে পিছু হটে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে চলে যান। কদর আলী আসেন বাড়িতে। উদ্দেশ্য খাওয়া-দাওয়া করে পাড়ি জমাবেন ওপারে। স্ত্রী খাতুন বিবি স্বামীর জন্য মুরগি জবাই করেন। কিন্তু খাওয়া হয়নি কদরের। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই হানাদাররা বাড়ি ঘেরাও করে তাকে আটক করে শ্রীমঙ্গলস্থ ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং ৭১-এর ৬ জুন জৈন উল্লাহ ও রহিম উল্লাহ এবং আবদুর রহমানের সঙ্গে তাকেও বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে।

শহীদ আলী আকবর : লইয়ারকুল গ্রামের আবদুল ছোবহানের ছেলে আলী আকবর ভারত থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন তিনি। দিনের বেলা কালেঙ্গা এলাকায় খামারে কাজ করতেন আর রাতের বেলা বেরিয়ে পড়তেন মিশনে। স্থানীয় রাজাকাররা বিষয়টি টের পেয়ে পাক বাহিনীর কাছে তার গতিবিধির খবর জানিয়ে দেন। এক দিন দুপুরে খামার থেকে আলী আকবরকে ধরে শ্রীমঙ্গলে নিয়ে যায় পাক বাহিনী। সহযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য জানাতে তার ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। নির্যাতনের মুখেও পাকিদের কোনো তথ্য দেননি তিনি। যার ফলে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ক্যাম্প থেকে শ্রীমঙ্গল শহরের সাধুবাবার গাছতলাসংলগ্ন ছড়ার পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হায়েনারা। পাকদের একটি গুলি তার পায়ে এবং একটি হাতে বিদ্ধ হয়। ছড়ার জলে লুটিয়ে পড়েন তিনি। অপারেশন শেষ করে চলে যায় হায়েনারা। ঘণ্টাখানেক পর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। ছড়া দিয়ে আশিদ্রোন ইউনিয়নের জানাউড়া এলাকায় পৌঁছার পর টহলরত রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন তিনি। রাজাকাররা তাকে সিন্দুরখানে অবস্থিত পাক সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরদিন পাক পশু শেরখানের গুলিতে প্রাণ হারান আলী আকবর। সিন্দুরখান বধ্যভূমিতে শেষ ঠিকানা হয় তার।

শহীদ আলী আজগর : লইয়ারকুল গ্রামের আবদুল ছোবহানের ছেলে আলী আজগরের মৃত্যু বীরত্বপূর্ণ। আলী আজগর দিনের বেলা কালেঙ্গা এলাকায় কৃষিকাজ করতেন, আর রাতে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মাইন পুঁতে রাখতেন পাকদের যাতায়াতের রাস্তায়। এক দিন রাজাকাররা তাকে ধরিয়ে দেয়। পাক হায়েনারা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কালেঙ্গার অফিস টিলায় নিয়ে যায়। পাক হায়েনারা টহল শেষে অফিস টিলায় বসে আড্ডা দিত আর ধরে আনা মুক্তিকামীদের পাহাড়ের ভেতর নিয়ে গিয়ে হত্যা করত। ধরা পড়ার আগের দিন অফিস টিলায় একটি মাইন পুঁতে রেখেছিলেন শহীদ আলী আজগর। অফিস টিলার যে স্থানে তিনি মাইনটি পুঁতে রেখেছিলেন; সেখানে পৌঁছার পর মাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে আর অগ্রসর হতে পারবেন না বলে বচসা শুরু করে দেন তিনি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এমনটি করেন আলী আজগর। মনে মনে তিনি সংকল্প করেন, একা মরব না তোদের সঙ্গে নিয়েই মরব। তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরো দুজন পাক সদস্য এগিয়ে আসে। তিন পাকসেনা এবং এক রাজাকার তাকে জোরপূর্বক সেখান থেকে নিয়ে যেতে চাইলে মাইনটির চাপ দেওয়া অংশ থেকে পা তুলেন শহীদ আলী আজগর। সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে বিস্ফোরণ। তিন পাকসেনা এবং এক রাজাকার মারা যায়। আর শহীদের খাতায় যুক্ত হয় আরো একটি নাম।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close