ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

  ০৫ নভেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

মূলধারার শিক্ষার বিকাশেই জাতি এগিয়ে যাবে

বিশ্বায়নের চাপে ও মোহে আত্মসংবিৎ হারিয়ে চললে কে বা কারা আমাদের উদ্ধার করবে? উন্নতির মূলে থাকে আত্মনির্ভরতার প্রচেষ্টা; এতে কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। বাইরে থেকে আমরা নেব, আত্মশক্তি বাড়ানোর জন্য কোনো অবস্থাতেই আত্মনির্ভরতা বিসর্জন দেওয়া যাবে না। আত্মশক্তি ও আত্মনির্ভরতার কোনো বিকল্প নেই। ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তার এবং কর্মের প্রগতিশীল নতুনধারা সৃষ্টি করতে হবে। কিছু যোগ্য ব্যক্তি যদি পরিচ্ছন্ন ভূমিকা নিয়ে এতে অগ্রযাত্রী হন, তাহলেই আমাদের এসব কথা অর্থবহ হবে।

বর্তমানে আমরা যেটাকে মূলধারা বলছি, এটা হচ্ছে প্রকৃত প্রস্তাবে ঔপনিবেশিক ধারা। অনেকে বলে, কওমি মাদরাসা ১৮৬৬-৬৭ থেকে তৈরি করেছে দেওবন্দরা। কথাটা আংশিক সত্য, কারণ এর আগে তো মাদরাসা ছিল এ দেশে। ইংরেজি ১৮২৮ থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত এই বিশ বছরে বাংলার মোট জমির ৫ ভাগের ১ ভাগ মানে শতকরা ২০ ভাগ ছিল এই মাদরাসার সম্পত্তি। লাখে রাজ বলা হতো অর্থাৎ যাকে খাজনা দিতে হয় না। এগুলো বাংলার নবাবরা দিয়েছেন, যারা স্বাধীন নবাব ছিলেন। এগুলো মোগল গভর্নররা দিয়েছেন এবং স্থানীয় জমিদাররা দিয়েছেন। এই জমিটা ইংরেজরা বাজেয়াপ্ত করে, ফলে মাদরাসাগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তারা ইংরেজি শিক্ষা চালু করে। বিখ্যাত কবি মাইকেল মধুসূদন যিনি ধর্মান্তরী হয়েছিলেন, রাজা নারায়ণের ছেলে কিন্তু খ্রিস্টান হয়েছেন বলে ওই কলেজে পড়তে পারেননি। তাকে বিশপ কলেজে পড়তে হয়েছে হুগলিতে গিয়ে। এটাই ছিল নিয়ম। পরে খ্রিস্টানদের ভর্তি করাতে হচ্ছে বলেই এটার নাম প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়েছে। তখনকার মুসলমানরা ইংরেজি পড়তে চান না বলে যে অপবাদ দেওয়া হয়, এ কথা সত্যি নয়। কলকাতায় ১৮৩০ সালের দশকে ১০ হাজার মুসলমানের স্বাক্ষরসংবলিত একটা চিঠি গভর্নর জেনারেলকে দেওয়া হয়, আমরা ইংরেজি শিখতে চাই, ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হোক, করা হয়নি। করা হয়েছিল কখন? ১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় একটি মাদরাসা তৈরি করেন, যেটার নাম আলিয়া মাদরাসা হয়েছে। এখন কওমি মাদরাসার লোকেরা ব্যঙ্গ করে বলে তোমরা তো ওয়ারেন হেস্টিংসের মাদরাসার ছাত্র। এই মাদরাসায় ১৯৪৭ পর্যন্ত ইংরেজরাই প্রিন্সিপাল ছিলেন। সবাই বলে এর খরচের টাকাটা ওয়ারেন হেস্টিংসের পকেট থেকে গেছে, তা সত্যি নয়। ১৮১৩ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ঘটনার ৩৩ বছরে ইংরেজ সরকার ভারতের যেকোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার জন্য একটি পয়সাও বরাদ্দ করেনি। এখন ১৭৮০ সালে তাহলে টাকাটা কোথা থেকে পেয়েছিল? এই টাকাটা পেয়েছিল হাজী মো. মহসিনের তহবিল থেকে। মহসিন কী করেছিলেন? তিনি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ১ কোটি রুপি ধার দিয়েছিলেন, বছরে ৫ টাকা সুদের হারে। তাহলে সুদ হতো বছরে ৫ লাখ টাকা করে। এই টাকা দিয়ে শুধু কলকাতার আলিয়া মাদরাসা চলেনি, দিল্লির কলেজ পর্যন্ত চলেছে। আমাদের বাংলাদেশে হেন ভদ্রলোক নেই, মুসলমান, হিন্দু সবাই, যারা এই টাকা থেকে লাভবান হননিা। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বঙ্কিম ওই টাকায় পড়াশোনা করেছেন, স্যার সৈয়দ আমির আলী, স্যার আব্দুর রহিম ইত্যাদি। এই হচ্ছে বাংলাদেশের তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থা।

২০১০ সালের শিক্ষানীতি দ্বারা চলমান ভাষা ও সংস্কৃতি-পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে এখন শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের বেলায় কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেওয়া উচিত বাংলাদেশ-উপযোগী করে পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের উন্নয়নে। পাঠ্যপুস্তকের বেলায় জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি গ্রহণ করা অপরিহার্য। শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দরকার। মূলধারার উন্নয়নকেই অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার, এর মধ্যে থাকবে মাদরাসার বিবেচনা। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষামুখী মনোভাবের স্থলে জ্ঞানমুখী মনোভাব সৃষ্টি করা দরকার। তার কথিত সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির আমূল সংস্কার অপরিহার্য। স্কুলে পাবলিক পরীক্ষা বাড়ানোতে কোচিং সেন্টার ও গাইডবুকের ব্যবসায়ে স্বর্ণযুগ দেখা দিয়েছে, শিক্ষায় কোনো সুফল হচ্ছে না। মূলধারার শিক্ষাকে উন্নত করার আগেই মাদরাসার আধুনিকায়নে গুরুত্ব দিলে তাতে সুফল হয় না।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এতই জটিল রূপ দেওয়া হয়েছে এবং এতে ক্রমাগত এত পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে যে, এ সম্পর্কে কোনো পরিচ্ছন্ন ধারণা নিয়ে চলা দুঃসাধ্য। গ্রামে এবং শহরে অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজ এখন ইংলিশ ভার্সনের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। এরই মধ্যে কেবল ইংলিশ ভার্সন নিয়ে নতুন অনেক প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে এবং আরো হচ্ছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি ইংলিশ ভার্সনের এই ব্যবস্থাকে অব্যাহত রেখেছে। এর দ্বারা শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারার এই বিভাজনকে নতুন করে বেগবান করা হচ্ছে। এ-লেভেল, ও-লেভেল সরকার যে হাত দেবে, তা মনে হয় না। একশ্রেণির অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, আমলা, পুঁজিপতি ও এনজিওপতির মধ্যে এখন ইংরেজির প্রতি অন্ধ আগ্রহ লক্ষ করা যায়। ১০, ২০, কী ৩০ বছর পরে বাংলাদেশে শিক্ষার এবং শিক্ষার মাধ্যমের অবস্থা কী দাঁড়াবে? তত দিনে আমাদের রাষ্ট্রইবা কী প্রকৃতি লাভ করবে? রাষ্ট্র কি গড়ে উঠবে? রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তানকালের একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের স্পিরিটের ধারাবাহিকতায় এগোবার কোনো প্রবণতা তো খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের মনে হয়, যেখানে বাংলা মাধ্যম নিকৃষ্ট, সেখানে এই ইংলিশ ভার্সন অবশ্যই নিকৃষ্টতর হচ্ছে। ইংলিশ ভার্সনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ভালো হতেই পারে না। যে অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে, তাতে বাংলা মাধ্যমও নিম্নগামীই থাকবে। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের বিবেচনাশীল হওয়া উচিত। বাঙালি-সন্তানের প্রথম ভাষা বাংলা, দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি; যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে এ দুটো ভাষাই শিখতে হবে। তবে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিকে রাখতে হবে কেন্দ্রীয় অবস্থানে।

শিক্ষাব্যবস্থায় দেশি-বিদেশি কায়েমি-স্বার্থবাদী বিভিন্ন শক্তির চাপিয়ে দেওয়া বিষয়গুলোকে বাংলাদেশের জন্য নির্বিচারে গ্রহণ করা হচ্ছে। অনেক কিছুই জনস্বার্থবিরোধী। নানা কৌশলে জনসাধারণকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। সমাজের ভেতর থেকে উন্নত মূল্যবোধ ও বিচার-বিবেচনা নিয়ে কোনো শক্তিকে আত্মপ্রকাশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রচার মাধ্যম প্রায় সম্পূর্ণই কালোটাকার মালিকদের, ঋণখেলাপিদের, বাইরের বৃহৎ শক্তিবর্গের অন্ধ অনুসারীদের মালিকানায়, দখলে ও পরিচালনায় আছে। বিশ্ববাস্তবতাও সম্পূর্ণ তাদেরই অনুকূলে। প্রচার মাধ্যম হিসাবে বিবিসি রেডিও বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রভাবশালী। পৃথিবীর সর্বত্রই যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগীদের শক্তি ও দাপট সীমাহীন। বিশ্বায়নের এই তো বাস্তবতা।

ইংলিশ ভার্সন অবিলম্বে বন্ধ করে দিয়ে আমাদের উচিত জাতীয় প্রয়োজন অনুযায়ী ইংরেজি শেখার ব্যবস্থাকে নবায়িত করা। ইংরেজিতে গুরুত্ব বেশি দিয়ে আরো কিছু বিদেশি ভাষা ভালো করে শেখার সুব্যবস্থা বাংলাদেশে করা দরকার। সারা দেশের সব শিশুকেই বিদেশি ভাষা শেখানোর দরকার নেই। দরকার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের আমূল পরিবর্তন করে শিক্ষার দ্বারা আমাদের রাষ্ট্রের, জাতির ও জনগণের আত্মশক্তি বৃদ্ধির পথ সুগম করা। জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ হওয়া উচিত আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম মূল নীতি। মূলধারার শিক্ষায় উন্নতি ঘটানো গেলে পরে মাদরাসার সংস্কারে দৃষ্টি দেওয়া যাবে। শেষে দৃষ্টি দিতে হবে এ-লেভেল, ও-লেভেল। প্রথম ও প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের জনগণের সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সার্বিক-আত্মবিকাশকে যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করে সর্বনি¤œ পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। জাতীয় হীনতারোধ কাটিয়ে ওঠার উপায় বের করতে হবে। বাংলাদেশকে জনগণের রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার নীতিতে অটল থাকতে হবে। জাতীয় স্বার্থ ও সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে এ লেখাটিকে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক সাহেবের একটি লেখা থেকে সংকলন করা হয়েছে, যা পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হলে অনেক পাঠকের মূলধারা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ জন্মাবে।

বিশ্বায়নের চাপে ও মোহে আত্মসংবিৎ হারিয়ে চললে কে বা কারা আমাদের উদ্ধার করবে? উন্নতির মূলে থাকে আত্মনির্ভরতার প্রচেষ্টা; এতে কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। বাইরে থেকে আমরা নেব, আত্মশক্তি বাড়ানোর জন্য কোনো অবস্থাতেই আত্মনির্ভরতা বিসর্জন দেওয়া যাবে না। আত্মশক্তি ও আত্মনির্ভরতার কোনো বিকল্প নেই। ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তার এবং কর্মের প্রগতিশীল নতুনধারা সৃষ্টি করতে হবে। কিছু যোগ্য ব্যক্তি যদি পরিচ্ছন্ন ভূমিকা নিয়ে এতে অগ্রযাত্রী হন; তাহলেই আমাদের এসব কথা অর্থবহ হবে।

ইচ্ছাশক্তি ও ইচ্ছা লাগবে। প্রবল ইচ্ছা ছাড়া হবে না। আর চিন্তা ও কাজ দুই-ই লাগবে; কেবল চিন্তা বা কাজ দিয়েও হবে না। সৃষ্টিশীল, প্রগতিশীল চিন্তার ও কাজের নতুন কেন্দ্র এবং ধারা সৃষ্টি হোকÑ এই আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close