ইসমাইল মাহমুদ

  ০৪ নভেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

শিক্ষাবর্জিত প্রতিবন্ধী শিশুরা

বর্তমান সরকারের শাসনামলে দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ। গত দেড় দশক আগেও ঝরে পড়ার হার ছিল ২০ শতাংশ আর এখন তা নেমে এসেছে ৫ শতাংশে। দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ উপবৃত্তি চালু হয়েছে। চালু হচ্ছে মিড-ডে-মিল বা দুপুরের খাবার। আগামী শিক্ষাবর্ষের শুরুতে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই প্রদানের পাশাপাশি স্কুল ড্রেসের জন্য নগদ ২ হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষায় যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে এটি আশার কথা। কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এ সাফল্য থেকে অনেকটাই বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশু। একাধিক গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া গেছে, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর ৬৫ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী প্রতিবন্ধী শিশুর ৬৫ শতাংশই এখনো বিদ্যালয়ের শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ৭৫ শতাংশই এখনো রয়ে গেছে শিক্ষার বাইরে।

২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় প্রতিবন্ধী ও শারীরিক ত্রুটিযুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯৬ হাজার ৩৮৫ জন। এর মধ্যে শারীরিক ত্রুটিযুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা হলো ২৯ হাজার ৫৫ জন। আর বুদ্ধি ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩ হাজার ৭৩৯ জন। এ ছাড়া রয়েছে দুর্বল দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাকশক্তি প্রতিবন্ধী, অটিজম ও অন্যান্য সমস্যায় ভোগা শিক্ষার্থীও। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর পরিচালিত বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয়শুমারি ২০১৮ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের কুড়িগ্রাম জেলার হতদরিদ্র পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে ‘হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল-হিউম্যানিটি অ্যান্ড ইনক্লুসন (এইচআই) বাংলাদেশ’ প্রোগ্রাম। এ প্রকল্পের প্রভাব নির্ণয়ের লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপ ও গবেষণাটি পরিচালনা করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি)’। এ সংস্থার গবেষক দলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. মুহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকীসহ বেশ কয়েকজন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ। গবেষক দল তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ‘র‌্যানডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল অন দ্য ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুসিভ প্রভার্টি গ্র্যাজুয়েশন মডেল বেজলাইন রিপোর্ট’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুড়িগ্রাম জেলার দুটি উপজেলায় প্রতিবন্ধী রয়েছে এমন ৬৮৬টি হতদরিদ্র পরিবারে জরিপ চালিয়ে এসব পরিবারের প্রতিবন্ধী ও অন্য সদস্যদের শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও আয়বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, এসব পরিবারের ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সি বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী প্রতিবন্ধী শিশুর মধ্যে ৬৫ শতাংশই স্কুলে যাচ্ছে না। এ ছাড়া এসব পরিবারের মোট প্রতিবন্ধীর ৭৫ শতাংশ কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি। আর শিক্ষার আওতায় আসা ৩৫ শতাংশ প্রতিবন্ধীর ১৫ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা শুধু সাক্ষর জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ। বয়স্ক প্রতিবন্ধীদের অধিকাংশই গবেষক দলকে জানিয়েছেন, তারা তাদের জীবনের এক দিনও কোনো স্কুলে যাননি। বাকি অংশ যারা স্কুলে গেছেন তাদের শিক্ষার দৌড় প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। কেউই নিজের অনিচ্ছায় বা পরিবারের অনীহায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ পাননি।

বর্তমান সরকার কয়েক বছর ধরে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার বিষয়ে জোর দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে সে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি পাঁচজন প্রতিবন্ধী শিশুর অভিভাবকের মধ্যে তিনজন অভিভাবকই জানান, তাদের সন্তান স্কুল বা মাদরাসায় যায়। শ্রেণিকক্ষে প্রতিবন্ধী শিশুর সহপাঠীরা তাদের নিয়ে নানাভাবে হাসি-তামাশা করে। কেউ কেউ প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করে এবং বিভিন্ন অকথ্য ভাষায় সম্বোধন করে। সুস্থ-সবল শিশু পারতপক্ষে প্রতিবন্ধী শিশুর সঙ্গে মিশতে চায় না বা খেলাধুলায়ও অংশ নিতে দেয় না।

গবেষক দল সেসব পরিবারে প্রতিবন্ধী রয়েছেÑ এমন দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য সংগ্রহ করে। ওই তথ্যে দেখা যায়, প্রতিবন্ধী এসব পরিবারে সাত বছরের অধিক বয়সি সদস্যদের ৩৫ শতাংশই কোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করেনি। শুধু সাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন রয়েছে ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করেছে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পাস বা পিইসি স¤পন্ন করেছে মাত্র ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতে পেরেছে মাত্র ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবার থেকে প্রতিবন্ধী শিশুর শতকরা ৬৫ শতাংশ বিদ্যালয়ে গমন করলেও ৯৫ দশমিক ৭৫ শতাংশই মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করতে পারছে না। এর আগেই তারা ঝরে পড়ছে।

শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কয়েক বছর ধরে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখনো চলছে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার প্রচেষ্টা। তবে এসব উদ্যোগ নিয়ে খুব একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। গবেষণায় যে তথ্য এসেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে এখনো প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়েই রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাস¤পন্ন এসব শিশুকে বাদ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক

শিক্ষা নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব এসব শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপ জোরালো করা প্রয়োজন। এসব শিশুকে সমন্বিত শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে আগামীতে তারা দেশের বোঝা নয়, সম্পদে পরিণত হবে। এ ছাড়া এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় হতদরিদ্র পরিবার বিষয়ে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে; সেটিও অর্জন সম্ভব হবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close