রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৪ নভেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

স্মার্টফোন এবং আনস্মার্ট সিদ্ধান্ত

নতুন যেকোনো কিছুই শিশুর কাছে অনেক আকর্ষণীয়। আর তা যদি হয় ইন্টারনেট সংযোগসহ স্মার্টফোন; যার মধ্যে একই সঙ্গে গান, গেমস, কার্টুন, ফানি ভিডিওসহ শিশুর পছন্দনীয় প্রায় সবকিছুই আছে; তাহলে তো কথাই নেই। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের এই যুগে এসে আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। অতিরিক্ত ব্যস্ততার কারণে অনেক বাবা-মাই শিশুর পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। নিজেদের অনুপস্থিতির সময়টায় শিশুকে শান্ত রাখতে তাই অনেকেই মোবাইল ফোনের শরণাপন্ন হচ্ছেন। আপনি হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। আপনার পাশে বসে বাচ্চাটা খুব দুষ্টুমি করছে। বাচ্চাকে শান্ত রাখার জন্য তার হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব ধরিয়ে দিলেন। গান, কার্টুন বা মজার ভিডিও ছেড়ে দিয়ে তাকে নিমেষেই শান্ত করে আপনি আপনার কাজে মনোনিবেশ করলেন। আপনার-আমার সবার বাসাতেই এই চিত্র এখন নিত্যদিনের। স্মার্টফোনের কল্যাণে শিশুকে শান্ত রাখা, খাওয়ানো, এমনকি বর্ণমালা ও ছড়া শেখানোর কাজটিও বাবা-মায়ের জন্য অনেক সহজ ও স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠেছে। বিপরীতে স্মার্টফোনের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে শিশুর। আর এই নির্ভরশীলতাই হয়তো আমাদের অজান্তে শিশুর জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে। অথচ আমরা কি তা নিয়ে ভাবছি? কিন্তু ডাক্তারি গবেষণা মতে, স্মার্টফোনের অতি ব্যবহারে শিশুর মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুর চিন্তা ও কল্পনাশক্তি ধীরে ধীরে স্মার্টফোনের রঙিন পর্দার গন্ডিতে আটকা পড়ে যায়। ক্রমান্বয়ে মাদকাসক্তির মতোই শিশু আক্রান্ত হয়ে পড়ে স্মার্টফোন আসক্তিতে। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের মানসিক বৈকল্য।

এমনকি চিকিৎসকরা এও জানাচ্ছেন যে, স্মার্টফোন আসক্তির কারণে শিশুর শুধু মানসিক বিকাশই যে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, বরং তারা শারীরিকভাবেও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে প্রযুক্তিগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার মধ্যে স্মার্টফোন অন্যতম। এটি যেমন দরকারি, তেমনি এর প্রতি আসক্তি আপনার সন্তানকে নানা বিপদে ফেলতে পারে। স্মার্টফোন আপনার সন্তানের জীবনযাপনের প্রতি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যেমন; খুব বেশি কম্পিউটার ও মোবাইল ব্যবহারের ফলে শিশুর মধ্যে আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। আপনার শিশুকে আচরণগত সমস্যার ঝুঁকি থেকে দূরে রাখতে চাইলে সচেতনতার বিকল্প নেই। অনেক মা-বাবা শিশুকে ব্যস্ত বা শান্ত রাখতে হাতে মোবাইল দিয়ে রাখেন। নিজেদের সুবিধা বা আরামের ফল পরবর্তীতে ভয়ংকর হতে পারে। বিশেষ করে একেবারে ছোট বয়সে মোবাইল হাতে দিলে শঙ্কাটা বেশি। যে শিশু নিয়মিত মোবাইল ব্যবহার করে, তাকে কয়েক দিন মোবাইল থেকে দূরে রাখুন। তার আচরণের পরিবর্তনটুকু নিজেরাই বুঝতে পারবেন। তবে ৭ বছর বয়সের শিশুর দিনে আধ ঘণ্টা মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টিভি বা ট্যাবলেট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি শিশু যখন একটি বই পড়ে বা ছবির বই দেখে, তখন কিন্তু সে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে কখন সে বইয়ের পাতা উল্টাবে। অর্থাৎ শিশুটি তখন তার নিজের গতিতে চলতে পারে। ফলে তাকে তাড়াহুড়ো করতে হয় না। বিজ্ঞানের অগ্রগতির দিনে ইন্টারনেট তথা তথ্যপ্রযুক্তি থাকবেই। একে এড়িয়ে জীবন চলার কোনো উপায় নেই। তবে এ কথা ঠিক যে, জীবনের প্রয়োজনে বিজ্ঞানের অবদান থেকে এই শিশু-কিশোর কতটুকু গ্রহণ করতে পারছে।

স্বাধীনতা দিতে গিয়ে তা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়; এই ব্যাপারটা প্রত্যেক অভিভাবকেরই বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার আগে তাই তার বয়স উপযোগী মোবাইল ফোন পছন্দ করতে হবে। অন্তত কৈশোরকালীন সময়টায় মোবাইল ফোন খুব দরকার না, না দেওয়াই ভালো। এখনকার শিশু প্রযুক্তিপণ্যে এতটাই আসক্ত হয়ে যাচ্ছে যে, শিশুর হাত থেকে মোবাইল ফোন বা ট্যাব কেড়ে নিলে তারা রেগে যায় বা নেতিবাচক আচরণ শুরু করে। তারা অন্য কোনো দিকে খেয়াল করে না, কারো সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। তারা মোবাইল, ট্যাবে চোখ রাখে বেশি সময়। এতে পারিবারিক বন্ধনের ধারণায় পরিবর্তন আসছে। ইন্টারনেট সংযোগসহ স্মার্টফোন যার মধ্যে একই সঙ্গে গান, গেমস, কার্টুন, ফানি ভিডিওসহ শিশুর পছন্দনীয় প্রায় সবকিছুই আছে। শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার আগে ইন্টারনেটে নিরাপত্তার বিষয়টি অভিভাবককে ভেবে দেখতে হবে। এক থেকে পাঁচ বছরের শিশু মোবাইল ফোন কী জিনিস, তা বোঝার কথা না। অভিভাবকরা তাদের হাতে মোবাইল ফোন-স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছেন। অনেক বাবা-মা ক্রেডিট মনে করে বলেন, আমার বাচ্চা ডাউনলোড করতে পারে। কিন্তু বুঝতে পারেন না বাচ্চাটা কোনদিকে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য মোবাইল ফোন আমাদের জন্য এখন অত্যাবশ্যকীয়, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মনোবিজ্ঞানীরা এই নেশাকে ‘ডিজিটাল কোকেন’ নাম দিয়েছেন। আর এই ডিজিটাল কোকেনের নেশায় আসক্তির শিকার আজ ধনী-গরিব নির্বিশেষে হাজার হাজার শিশু-কিশোর-তরুণসহ প্রায় সব বয়সি মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্য হলো, ২০১০ সাল থেকে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীর বিষণœতায় ভোগা ও আত্মহত্যাপ্রবণতা বেড়ে গেছে। কিশোরীর ক্ষেত্রে এ হার তুলনামূলক বেশি। পরবর্তী ৫ বছরে যা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৬৫ ভাগে। আর বিষণœতায় ভোগার হার বেড়েছে ৩৩ ভাগ। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের এই যুগে এসে আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। অতিরিক্ত ব্যস্ততার কারণে অনেক বাবা-মাই শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। নিজেদের অনুপস্থিতির সময়টাতে শিশুকে শান্ত রাখতে তাই অনেকেই মোবাইল ফোনের শরণাপন্ন হচ্ছেন। ভবিষ্যতে কী হবে ভেবে দেখা হচ্ছে না। ফলে বাবা-মার প্রতি, ভাইবোনের প্রতি ইমোশন কমে যাচ্ছে। শিশুর বিভিন্ন ধরনের চোখের সমস্যা দেখা দেয়। বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া স্কুলের রেজাল্ট দিন দিন খারাপ হতে থাকে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন। ফেসবুকের এই যুগে তা যেন আরো বেড়ে চলেছে ফেসবুকের নেশা। গবেষকদের মতে, এজন্য দায়ী স্মার্টফোন ও প্রযুক্তিপণ্যের অতিরিক্ত ব্যবহার এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার বাস্তবজীবন থেকে আলাদা করে ফেলতে পারে। প্রযুক্তি আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনটা যেন ক্ষতিকর পর্যায়ে নিয়ে না যায়। প্রযুক্তি কি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে? না আমরা প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করব? আজকের শিশু-কিশোরই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে খোলা মাঠে খেলাধুলা করার ব্যবস্থা করুন। শহরের বাস্তবতায় সে সুযোগ কম, তাই বলে কি তাদের শৈশবের দুরন্তপনা থেমে যাবে।

এমনকি বাবা-মার সঙ্গে দূরত্বের কারণে সন্তান ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই তাকে সময় দিতে হবে। জাতির স্বার্থে তাই তাদের অধঃপতনের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। জাতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে হলে শিশু-কিশোরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে চলা সম্ভব নয়। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিশুকে কীভাবে সামাজিক হওয়া যায়, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, খেলাধুলা করা, তাদের নানা রকম গুণ আমাদেরই বের করে আনতে হবে। ডাক্তারি গবেষণা মতে, স্মার্টফোনের অতি ব্যবহারে শিশুর মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুর চিন্তা ও কল্পনাশক্তি ধীরে ধীরে স্মার্টফোনের রঙিন পর্দার গন্ডিতে আটকা পড়ে যায়। স্মার্টফোনের মাধ্যমে শিশু অপ্রাপ্ত বয়সেই না বুঝে বিভিন্ন অনৈতিক ও আপত্তিকর বিষয়বস্তুর সম্মুখীন হয়। সহজেই এ বিষয়গুলোর মুখোমুখি হওয়াতে তারা এগুলোকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে। এ কারণে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট আসক্ত শিশু ও তরুণের মাঝে নৈতিকতার অভাব ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এ আসক্তির ফলে খিটখিটে মেজাজ ও একঘেয়েমি কাজ করে। এ ছাড়া অনেক সময় ধরে ফোন ব্যবহারের কারণে শিশু পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত হয়। এতে তারা মনোযোগের ঘাটতিজনিত চঞ্চলতা নামক জটিলতায় ভোগে। অতিরিক্ত সময় ধরে ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে শিশুর বিভিন্ন ধরনের চোখের সমস্যা দেখা দেয়। মনে রাখতে হবে, স্মার্টফোন তথা ইন্টারনেট আসক্তি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়। শিশুর ধৈর্য ও মনোযোগ কমিয়ে দেয়।

যার ফলে শিশু ধীরে ধীরে অসহিষ্ণু, অসামাজিক ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তার সহজাত সামাজিক গুণাবলির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। শিশু বেশির ভাগ সময়ই শুয়ে বা বসে ফোন ব্যবহার করে। আর স্মার্টফোন আসক্ত শিশু ঘরের-বাইরে খেলাধুলাতেও আগ্রহী হয় না। ফলে শৈশবকালীন অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধির হার তাদের মধ্যে খুবই বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, পরে এসব শিশুর ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন জটিলতা যেমন : হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close