দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

জাতীয় গ্রিডে সৌরবিদ্যুৎ

জীবন যেমন থেমে থাকে না, থেমে থাকে না উন্নয়নের উদ্যোগ-আয়োজনও। সে কারণে বিদ্যুৎ ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে সবসময়। তেমনি বিকল্প শক্তির অনুসন্ধানও করতে হয়েছে আমাদের। গ্যাস ও তেলশক্তির সাহায্যে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের দ্রুত জোগান নিশ্চিত করা সহজসাধ্য নয় বলেই বিকল্প বিদ্যুৎশক্তির প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতা বেশি করে সামনে এসেছে। এই প্রয়োজন মেটাতেই সম্ভাবনার আলোকবর্তিকা নিয়ে এসেছে সৌরবিদ্যুৎ।

ন্যূনতম রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে বাড়ির যেকোনো রৌদ্রময় স্থানে সহজেই এটি স্থাপন করা যায়। এই বিদ্যুতে উচ্চ ভোল্টেজ না থাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট বা তড়িতাহত হওয়ার আশঙ্কা নেই। সৌর প্যানেলের ওপর ভিত্তি করে এটি প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত সেবা দিতে পারে। এছাড়া রয়েছে শক্তিশালী চার্জার, যা অতিরিক্ত ভোল্টেজ, কম ভোল্টেজ ও শর্টসার্কিট থেকে সব ধরনের বৈদ্যুতিক পণ্য রক্ষা করে। বাংলাদেশের যেসব এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ নেই, সেসব এলাকার অনেক পরিবারই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকে। একসময় সৌরবিদ্যুৎ শুধু বাড়িতে ব্যবহার করা হতো। হোম সিস্টেম ছাড়াও এখন বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক, এমনকি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে মেশিন চালানোর কাজেও সৌর প্যানেল ব্যবহার করা হচ্ছে। সৌরবিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে বেশকিছু পশ্চাৎপদ এলাকা; বিশেষ করে যেখানে বিদ্যুৎ যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

দেশে বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এখানে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা এখনো সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুৎ হতে পারে সম্ভাবনাময়। এরই মধ্যে এ সম্ভাবনার আভাস সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের অনেক প্রত্যন্ত গ্রাম, চর ও পাহাড়ি এলাকায় এখন রাতে সৌরবিদ্যুতের বাতি জ্বলছে। রাতে বাতি জ্বালানো ছাড়াও বৈদ্যুতিক পাখা ও টেলিভিশন চালানোর কাজে সৌরবিদ্যুৎ এসব এলাকার মানুষের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একের পর এক এই সুবিধা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা এলাকায়।

২০০৩ সাল থেকে দেশে নানা এলাকা ইডকল, গ্রামীণ শক্তি, ব্র্যাক, সৃজনী প্রভৃতি কোম্পানি সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্ব পালন করে আসছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশের মতো একটি সৌর আলোকিত দেশে সারা বছরই পর্যাপ্ত পরিমাণ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এখানে বছরের ৩০০ দিনের বেশি সময় রোদ থাকে। ইউরোপ ও আমেরিকার খুব কম দেশে সারা বছর এত বেশি রোদ থাকে না। তা সত্ত্বেও সেখানে কার্যকর অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেক বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার।

বর্তমানে সৌরবিদ্যুৎচালিত পাম্পের সাহায্যে সেচকাজ চলছে। যদি পরিকল্পিতভাবে সারা দেশেই সৌরবিদ্যুৎচালিত পাম্পের সাহায্যে সেচকাজ করা সম্ভব হয় তাহলে বছরে বিপুল পরিমাণ ডিজেল সাশ্রয় হয়। ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এই ব্যবস্থায় কার্বন নিঃসরণ বন্ধের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব। কারণ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে পরিবেশবান্ধব। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাঙামাটির কাপ্তাই একটি স্মরণীয় নাম। প্রায় ৬০ বছর আগে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তান আমলে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার পর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদার বড় অংশ মেটানো হতো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিদ্যুৎ দিয়ে। সেই কাপ্তাইয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের প্রথম সরকারি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র। দুনিয়াজুড়ে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা দিয়ে বিদ্যুতের বড় অংশ উৎপাদিত হয়। দুনিয়াজুড়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনও ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু প্রাকৃতিক জ্বালানির মজুদ সীমিত হয়ে পড়ায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে উন্নত দেশগুলো। বাংলাদেশও এরই মধ্যে সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। কাপ্তাই ৭ দশমিক ৪ মেগাওয়াট সোলার পিডি কানেকটেড বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পাশাপাশি অচিরেই কাপ্তাইয়ে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরেকটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।

২০২০ সালের মধ্যে দেশে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদনের লক্ষ্য সামনে রেখে কাপ্তাইয়ে সরকারি উদ্যোগে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও ব্যক্তি-উদ্যোগে বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেল ব্যবহৃত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। সরকারি হিসাবে প্রায় ৪০ লাখ বাড়িতে সোলার হোম সিস্টেম রয়েছে। রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে সৌরশক্তির সাহায্যে সরকারিভাবে যে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে তাতে খরচ পড়েছে ১১০ কোটি টাকা। অর্থসহায়তা দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ৯ জুলাই। পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে বেশ আগেই। এ প্রকল্পের প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ টাকা ৪৮ পয়সা। সরকারিভাবে এটাই প্রথম কোনো সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, যেখান থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় অপেক্ষাকৃত বেশি হলেও ভবিষ্যতে যেহেতু প্রাকৃতিক জ্বালানি পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে সেহেতু নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদাপূরণে সৌরবিদ্যুৎকে অমিত সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস, এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবে।

লেখক : সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close